চীনা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মার সুপারইয়ট জেন
করোনাকালে বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়লেও বিলিয়নিয়ার তথা অতিধনীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ কামিয়েছেন। বদৌলতে এই সময়ে তাঁদের ধনসম্পদ বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে। সেই সঙ্গে তাঁদের খরচের বাহারও বেড়েছে। যেমন বিশ্বের শীর্ষ দুই ধনী ইলন মাস্ক ও জেফ বেজোস নিজ নিজ সংস্থার রকেটে চড়ে মহাকাশ ঘুরে এসেছেন। আবার অনেকেই মহাকাশে না গেলেও মহাসাগরে সুপারইয়ট ভাসিয়েছেন।
আগের তুলনায় চলতি ২০২১ সালে অতিধনীদের মধ্যে বিলাসবহুল প্রমোদতরি তথা সুপারইয়ট কেনার প্রবণতা বেশ বেড়েছে। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালেও তাঁদের সমুদ্রবিলাস আরও বাড়বে। সম্প্রতি সুপারইয়ট গ্রুপ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে (জানুয়ারি–অক্টোবর) ৩০ ফুটের বেশি লম্বা এমন ২০০টি সুপারইয়ট বিক্রি হয়েছে। ২০১৯ সালে বিক্রি হয়েছিল ১৬৫টি সুপারইয়ট। এক হিসাব অনুযায়ী চলতি ২০২১ সালে গত ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুপারইয়ট বিক্রি হবে। ২০২২ সালে সরবরাহের জন্য ইতিমধ্যে ৩৩০টি সুপারইয়ট কেনার আদেশও দিয়ে রেখেছেন অতিধনীরা।
সুপারইয়ট কী ও দাম কত
বৃহৎ আকারের ও বিলাসবহুল প্রমোদতরিকে বলা হয় সুপারইয়ট। সাধারণত এ ধরনের প্রমোদতরি ৭৪ ফুটের বেশি লম্বা হয়। কেউ কেউ অবশ্য ২০০ ফুটের বেশি লম্বা, আবার কেউবা ৩০০ ফুটের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজকে ‘গিগা ইয়ট’ বা সুপারইয়ট মনে করেন। আবার এসব ব্যাখ্যাকে প্রমোদতরি বিপণনের কৌশল হিসেবে দেখেন বিল স্প্রিঙ্গার, যিনি বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনে ইয়টশিল্প নিয়ে লেখালেখি করেন।
করোনার কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে যখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং লকডাউন তথা বিধিনিষেধের কারণে মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছিল, তখন অতিধনীরা ব্যাপক হারে লোকালয় ছেড়ে সুপারইয়টে চড়ে সমুদ্রে গিয়ে সময় কাটাতে শুরু করেন। এ প্রবণতা এখন আরও বেড়েছে।
সাধারণত সুপারইয়টের দাম ১ কোটি থেকে ৬০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৬ কোটি থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। করোনাকালে বিশ্বের শীর্ষ অতিধনীদের মধ্যে যাঁরা সুপারইয়ট কিনেছেন, তাঁদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ই–কমার্স আমাজনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেফ বেজোস ও চীনের ই–কমার্স আলিবাবার নির্বাহী চেয়ারম্যান জ্যাক মা অন্যতম। আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা বেজোস ৫০ কোটি ডলার বা ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় কিনেছেন ৪১৭ ফুট দৈর্ঘ্যের ইয়ট। এটি বিশ্বের বৃহত্তম পালতোলা ইয়ট, যা তৈরি করছে নেদারল্যান্ডসের ওসানকো নামক একটি প্রতিষ্ঠান। এটি চালাতেও ৬০ জনের মতো নাবিকের দরকার পড়ে। আর আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মার কেনা ৮৮ মিটার (২৮৯ ফুট) দৈর্ঘ্যের সুপারইয়টের দাম ২০ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। গত মাসে এ সুপারইয়টের প্রথম ভাসানে তিনি স্পেনের মালোর্কা দ্বীপে যান।
ফোর্বস-এর লেখক বিল স্প্রিঙ্গার বলেন, ভেতরকার শৈল্পিক কাজগুলো অত্যন্ত নিঃখুঁত হওয়াসহ কিছু বিশেষত্বের কারণে ইয়টের দাম বেশি হয়ে থাকে। ‘আমি সত্যি সত্যি খুব ধনী, তাই আমি এটা কিনেছি’—এ ধরনের মনোভাবও কাজ করে ইয়টের ক্রেতাদের মাথায়। সুপারইয়টগুলো তৈরি করা হয় ক্রেতাদের পছন্দ ও ফরমাশ অনুযায়ী। যে কারণে ইয়ট তৈরিতে নান্দনিক সৌন্দর্যের পাশাাপাশি আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলার ওপরও জোর দেওয়া হয়। অতিধনীরা ইয়টে চড়ে মোনাকোর মতো দেখতে আকর্ষণীয় বন্দরসহ বিদেশি আলো ঝলমল বন্দর শহর কিংবা অ্যান্টার্কটিকা ও পাপুয়া নিউগিনির মতো নিরাপদ ও নিরুপদ্রব জায়গাগুলোয় ঘুরতে পছন্দ করেন।
বিশ্বে অতিধনী বাড়ছে
করোনাকালে অন্য সবার আয়ে কমবেশি প্রভাব পড়লেও অতিধনীদের আয় ব্যাপক হারে বেড়েছে। চলতি ২০২১ সালের এপ্রিলের মধ্যে সমন্বিতভাবে অতিধনীদের সম্পদের পরিমাণ পাঁচ ট্রিলিয়ন বা পাঁচ লাখ কোটি মার্কিন ডলার বেড়েছে। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিলিয়নিয়ার তালিকায় ৪৯৩ জন অতিধনীর নাম যোগ হয়েছে। এর ফলে বিশ্বে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৫ জনে। যাঁদের সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা এর চেয়ে বেশি, তাঁদের নিয়েই ফোর্বস–এর তালিকা তৈরি করা হয়। প্রসঙ্গত, ১০০ কোটিতে এক বিলিয়ন। আর যাঁরা এক বিলিয়ন বা শতকোটি ডলারের সম্পদের মালিক, তাঁদের বিলিয়নিয়ার বলা হয়।
করোনার প্রথম নয় মাসে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ওয়াল স্ট্রিটের পুঁজিবাজারেই ৫৬ জন নতুন বিলিয়নিয়ার হয়েছেন। এর মধ্যে নয়জনই ভ্যাকসিন, মানে টিকাসংক্রান্ত গবেষণাজনিত মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে বিলিয়নিয়ার হন বলে জানায় অক্সফাম। এদিকে গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ (আইপিএস) জানায়, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়নিয়ারদের আয় ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার বা ৬২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স, দ্য বোরিং কোম্পানি ও বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান টেসলার সম্পদ ১৫ হাজার কোটি ডলার বা ৬০০ শতাংশ বেড়েছে।
ইতালির ইয়ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফেরেত্তি গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে মোট ১০৪ কোটি ডলার মূল্যের সুপারইয়ট বিক্রির আদেশ পেয়েছে। গোটা ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৬৯ কোটি ডলারের ইয়ট বিক্রির আদেশ পেয়েছিল।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভেসেলস ভ্যালুর সুপারইয়ট গবেষণা শাখার প্রধান স্যাম তাকার জানান, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রগুলোতে ৬৫ ফুটের বেশি লম্বা এমন ৯ হাজার ৩৫৭টি ইয়ট ভাসছে।
একটি ইয়ট তৈরিতে সাধারণত বছরখানেক সময় লাগে। তবে আকারে একটু বড় হলে আরও বেশি লাগে। এ তথ্য অবশ্য গোপন রাখা হয়। ইয়টের মালিকানার বিষয়টিও গোপন রাখা হয়। অর্থাৎ কোনটি কার ইয়ট বা কে কোনটির মালিক, তা প্রকাশ করা হয় না। এ নিয়ে ক্রেতার সঙ্গে নির্মাতার চুক্তি হয়ে থাকে, যাতে তথ্যটি প্রকাশ না পায়। সে জন্য ইয়ট খাতে একটি ‘অস্বচ্ছ শিল্প’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গেরও নিজস্ব সুপারইয়ট আছে বলে শোনা যায়।
সূত্র: আরব নিউজ ও রয়টার্স
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন