জার্মানির যে বন্যা বাংলাদেশের কথা মনে করিয়ে দেয়
জার্মানিতে হঠাৎ বন্যায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৮০ জন মানুষ, এখনো নিখোঁজ দেড় শতাধিক। ১৪ জুলাইয়ের সেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড নয়নার-আরভাইলার অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হলো।
ক্ষতচিহ্ন সর্বত্র
জার্মানির বাড নয়নার-আরভাইলার অঞ্চলে গেলেই ছোট্ট একটি খাল চোখে পড়বে। ‘আর’ নামের সেই নদী বাংলাদেশের বিবেচনায় অবশ্য খাল বলাই শ্রেয়। সাধারণত ষাট বা সত্তর সেন্টিমিটারের বেশি পানি থাকে না। কিন্তু টানা কয়েকদিনের ভারি বর্ষণে হঠাৎ করে সেই নদীর পানি বেড়ে কয়েক মিটার। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ছুটে আসে সেই পানিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় আশেপাশের এলাকা।
ভেঙ্গে গেছে ঘরবাড়ি, বিশেষ করে নীচের তলা
বাড নয়নার-আরভাইলার অঞ্চলের অনেক বাড়ি কয়েকশত বছরের পুরনো। সাধারণ সময়ে পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় এই অঞ্চলের সেসব বাড়িঘর পানির তোড় সামলাতে পারেনি। সেখানকার অনেক পুরনো বাড়ি পানির ধাক্কায় ভেঙ্গে গেছে, কিংবা নীচের তলার সবকিছু পানিতে ভেসে গেছে। ছবিতে ক্ষতিগ্রস্ত একটি বাড়ির ভেতরের চিত্র দেখা যাচ্ছে।
উপড়ে গেছে ট্রেন লাইন, ভেঙ্গে গেছে রাস্তা
বাড নয়নার-আরভাইলারের মূল ট্রেনলাইনটি পানির চাপে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও রেল লাইনের চিহ্নও নেই। এমনকি রাস্তাও আর নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। ছোট্ট নদীটিকে এখন বেশ বড় মনে হয়, যদিও পানি নেমে গেছে আগের মতোই অনেক নীচে।
রাস্তায় পড়ে আছে দামি গাড়ি
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার রাস্তাঘাটে এখনো পড়ে আছে অনেক গাড়ি। হঠাৎ বন্যায় সেসব গাড়ি দুমড়েমুচড়ে গেছে।
নেই বিদ্যুৎ কিংবা পানির সংযোগ
১৪ জুলাই বন্যার পর এখনো সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা যায়নি। বরং যেভাবে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা পুনরায় কবে চালু করা যাবে তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। তবে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সেখানে সব বাড়ির সামনে সাময়িক পানি কন্টেইনার বসানো হয়েছে। গাড়িতে করে পানিভর্তি সেসব কন্টেইনার নিয়ে যাওয়া হয়।
বিকল্প ব্যবস্থা জেনারেটর
বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা চালু না থাকলেও অনেক বাড়িতেই জেনারেটর চালু করা হয়েছে। এসব জেনারেটর থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে ঘরবাড়ির ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারসহ অন্যান্য কাজ করা হচ্ছে।
বড় চ্যালেঞ্চ আবর্জনা পরিষ্কার
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় হাজার হাজার টন ময়লা আবর্জনা সৃষ্টি হয়েছে যা না সরালে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন। আপাতত তাই বড় বড় ট্রাকে করে ময়লা আবর্জনা সরাতেই ব্যস্ত অনেকে।
সহায়তায় সেনাবাহিনী
আরভাইলার অঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সেনাবাহিনীও নিয়োগ করা হয়েছে। সেনা সদস্যরা এলাকাটি পরিষ্কারে সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন গাড়িতে তেলও ভরে দিচ্ছে বিনামূল্যে।
সময় লাগবে অনেক
বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এ রকম বন্যার সঙ্গে পরিচিত হলেও জার্মানিতে গত অর্ধশতকে এ রকম বন্যা দেখা যায়নি। শীতপ্রধান এই দেশটিতে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। জার্মানিতে এখন ঘনঘন দীর্ঘ সময় ধরে অবিরাম ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে যা অতীতে দেখা যায়নি।
বড় ক্ষতির মুখে ওয়াইন উৎপাদকরা
জার্মানির বাড নয়নার-আরভাইলার এলাকা ওয়াইনের জন্য বিখ্যাত। সেখানকার পাহাড়ে আঙ্গুর চাষ করা হয়। বন্যার কারণে ওয়াইন উৎপাদকরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। যেসব ওয়াইনের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো বিক্রি করে ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা করছেন অনেকে।
মানুষ মানুষের জন্য
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধারণ মানুষ গিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। কেউ কাজ করছেন সংগঠনের ব্যানারে, কেউবা একান্তই ব্যক্তি উদ্যোগে। তারা ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি খাবার এবং পানীয়ও পৌঁছে দিচ্ছেন।
গরম খাবারের আয়োজন
বাড নয়নারে গরম খাবারের আয়োজন করেছেন একদল স্বেচ্ছাসেবী। সেখানে কাজ করা প্রীতি জানান, প্রতিদিন ছয়হাজারের মতো মানুষকে গরম খাবার সরবরাহ করছেন তারা।
যার যা প্রয়োজন নিয়ে যাচ্ছেন
রাস্তার পাশে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা সেখান থেকে নিজেদের প্রয়োজনমত জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারছেন।
চালক, আরোহীদের জন্য পানীয়
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে পানীয় সরবরাহ করছেন একদল স্বেচ্ছাসেবী।
মানুষ মানুষের জন্য
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের পাশে দ্রুত দাঁড়িয়েছেন অন্যান্য এলাকার মানুষেরা। এই কঠিন সময়ে সাধারণ মানুষের এই সহযোগিতায় কৃতজ্ঞ বাড নয়নার-আরভাইলার অঞ্চলের বাসিন্দারা। বিভিন্ন বাড়ির সামনে তাই তারা ধন্যবাদ সূচক বিভিন্ন ব্যানার টাঙ্গিয়েছেন।
পর্যটকরা ফিরবেন কবে?
বাড নয়নার-আরভাইলার অঞ্চল অনেকটাই পর্যটন নির্ভর। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ সেখানে হাইকিং করতে কিংবা ওয়াইন পরখ করতে যান। তবে, পাহাড় ঘেরা এই অঞ্চলে পর্যটকরা আবার কবে যেতে পারবেন তা নিশ্চিত নয়। কেননা, বন্যার ক্ষতি মেরামতে আপাতত সেখানে স্বেচ্ছাসেবী, সাংবাদিক ও জরুরি সেবা প্রদানকারী ছাড়া অন্য কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। সূত্র: ডয়চে ভেলে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন