বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মুক্ত চিন্তার প্রবক্তা হিসেবে নিজেদের হাজির করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও তারা নিজেরাই এগুলো কতটা মানে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে প্রায়শই। এমনও দেখা গেছে, বিভ্ন্নি দেশের নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীদের দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানায় ওয়াশিংটন। এমন এক সময় এসব বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, যখন বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় রয়েছে। একইসঙ্গে নিজ দেশেই গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
গত এক শতাব্দীর মধ্যে প্রথমবারের মতো ভিন্ন চিত্র দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে বিশ্বও এমন চিত্র দেখে অবাক। প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন। পাশাপাশি নির্বাচনের কারচুপির মতো অবান্তর অভিযোগও এনেছেন। যা খোদ বর্তমান প্রেসিডেন্টের সাপোর্টারদেরও বিস্মিত করেছে।
এমনকি তার মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এমনটাও বলছেন ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় ট্রাম্প সরকারই দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। পরাজয়ের পরও এমন দম্ভোক্তি এবং ওয়াশিংটনে উদ্ভূত পরিস্থিতি আফ্রিকা, মধ্য আমেরিকা ও এশিয়ার কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকগোষ্ঠীকে অর্থাৎ স্বৈরশাসকদের অনুপ্রাণিত করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন রিপাবলিকান দলীয় এ প্রার্থী। ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে পরাজয় মেনে না নিয়ে নির্বাচনী ফলাফল পাল্টে দিতে আদালতের হস্তক্ষেপের পাশাপাশি রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করে আসছে রিপাবলিকান পার্টি ও ট্রাম্প সমর্থকরা।
বিশ্বের কাছে গণতন্ত্রের মডেল হিসেবে নিজেদের প্রচারকারী যুক্তরাষ্ট্রে এবার দেখা যাচ্ছে বাইডেনের প্রায় ৬০ লাখের অধিক ভোট ও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে ৩০৬-২৩২ ব্যবধান সত্ত্বেও কীভাবে ট্রাম্প পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন।
সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে ট্রাম্পের এ দাবির পক্ষে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মার্কিন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মার্কিন ভোটারের সমর্থন দেখা যাচ্ছে।
বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে, তারা বলছেন ট্রাম্পের এ নীলনকশা বিভিন্ন ভঙ্গুর গণতন্ত্রের দেশগুলোর সামনে রসদ হিসেবে হাজির হচ্ছে। বিশেষ করে আফ্রিকার অনেক কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক ট্রাম্প থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আরো কয়েক মেয়াদ ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখার ফুরসত পাচ্ছে।
থমাস ক্যারোথার্স নামে এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, কীভাবে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের বিরোধিতা করতে হয় সে বিষয়ে রাশিয়া, চীন ও মিসরের মতো কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর শেখার কিছু নেই। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না করে নামমাত্র নির্বাচনে একচেটিয়া জয়ের মাধ্যমে এরই মধ্যে এ বিষয়ে ওস্তাদি অর্জন করেছে কর্তৃত্বপরায়ণ ও স্বৈরাচারী সরকারগুলো।
এলড্রেড মাসুনানগুরে নামে ইউনিভার্সিট অব জিম্বাবুয়ের এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, স্বৈরশাসকদের কানে মধুর গান শোনাচ্ছেন। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমরা এমন দৃশ্য আফ্রিকায় দেখে দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু শতবর্ষের পুরনো গণতন্ত্রে যখন এমনটা হচ্ছে, তখন তা অবাক করার বিষয়।
রাশিয়ার দাবাড়ু লিজেন্ড এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বড় সমালোচক হিসেবে পরিচিত গ্যারি কাসপারভ বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পের এ আক্রমণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য জায়গার নির্বাচনেও তার পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে। এর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পুতিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো বলে এক টুইটে লেখেন তিনি।
এছাড়া ট্রাম্প গত চার বছর যেভাবে ‘ফেইক নিউজ’ গালি দিয়ে মার্কিন গণমাধ্যমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এসেছেন, তার অনুকরণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো তাদের গণমাধ্যমকে চাপে রাখার কৌশল গ্রহণ করছেন।
ক্যারোথার্স আরো বলেন, ট্রাম্পের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবিদার ভারত যেখানে ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশটির সুশীল সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নীতি গ্রহণ করছেন।
তবে কয়েকজন পর্যবেক্ষক অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন। ট্রাম্পের হাতে সব ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আগামী ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউজ ছেড়ে দিতে হবে তাকে। জঁ গ্যাসপার এনতোতাউমি আয়ি নামে গ্যাবনের এক বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ বলেন, গণতন্ত্রের শক্তি হচ্ছে তার প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
তিনি বলেন, আফ্রিকার দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পার্থক্য হচ্ছে সে জায়গায়, যেখানে তাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক শক্তিশালী। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণেই ট্রাম্পের মতো একজন পাগলাটে প্রেসিডেন্ট যেমন সর্বোচ্চ পদে বসতে পারেন আবার চলে যেতেও বাধ্য হতে পারেন।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন