ইউরোপে ইসলাম বিদ্বেষ ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি সুইডেনে পবিত্র কোরআন শরীফে অগ্নি সংযোগ এবং বিতর্কিত ফরাসি ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর পক্ষ থেকে বিশ্বশান্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে আবারও ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ করা থেকে বোঝা যায় ইউরোপে নতুন করে ইসলাম বিদ্বেষী তৎপরতা শুরু হয়েছে।
ইউরোপ মহাদেশে উগ্রপন্থীরা ইসলাম বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যার প্রথমটি হচ্ছে, ২০০৮ সাল থেকে চলে আসা অর্থনৈতিক সংকট এবং সম্প্রতি মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ইউরোপ জুড়ে সৃষ্ট নজিরবিহীন অর্থনৈতিক মন্দার কথা উল্লেখ করা যায়। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে ইসলাম অবমাননা ও মুসলিম অভিবাসীদের ওপর উগ্র খ্রিস্টান গ্রুপের হামলার ঘটনা বৃদ্ধি। ইউরোপের উগ্র ডানপন্থী খ্রিস্টানরা মুসলমানদেরকে হামলার টার্গেটে পরিণত করেছে। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)কে অবমাননা করে কার্টুন প্রকাশ, কোরআন অবমাননা, মুসলমানদের ওপর সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগানো, তাদের ওপর হামলা চালানো প্রভৃতি ইসলাম বিদ্বেষী পদক্ষেপের মাধ্যমে ইউরোপে বসবাসকারী মুসলমানের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে। ইউরোপে ক্রমবর্ধমান মুসলিম বিদ্বেষ ও ইসলাম আতঙ্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ওই অঞ্চলের সরকারগুলোর উচিত হবে না এ ব্যাপারে নীরব থাকা।
প্রকৃতপক্ষে, ইউরোপের উগ্রপন্থীদের এ ঔধ্যত্যের জন্য খোদ সেখানকার সরকারগুলোই দায়ী। গত বছর ডিসেম্বর আঙ্কারা ভিত্তিক সংস্থা ফাউন্ডেশন ফর পলিটিকাল, ইকোনোমিক এ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ সংক্ষেপে এসআইটিএ'র প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র ডানপন্থীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় সেখানে ইসলাম আতঙ্ক ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে ওই মহাদেশটির নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ নুসরাতুল্লাহ তাজিক মনে করেন, পরিস্থিতি এমন দিকে যাচ্ছে যে ইউরোপের মুসলমানরা আগে নিরাপত্তা অনুভব করত কিন্তু এখন তারা নিরাপত্তা বোধ করছে না এবং তারা ব্যাপক আতঙ্ক ও চাপের মুখে রয়েছে।
ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ বিশেষ করে ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, ব্রিটেন, সুইডেন, হল্যান্ড ও ডেনমার্কে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর প্রভাব ও তৎপরতা দিন দিন বাড়তে থাকায় সেখানে মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েই চলেছে।
সরকারের ভুল নীতির কারণে একদিকে এ দেশগুলোর যুবকরা উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে এবং মুসলমানদের ওপর প্রায়ই হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে সরকার অভিবাসীদের নিরাপত্তায় সহায়তার করার কথা বলছে। ইউরোপ জুড়ে অভিবাসীদের মধ্যে মুসলমানরাই হামলার মূল টার্গেট। হামলা ও সহিংসতার পাশাপাশি চলছে ব্যাপক অপপ্রচার। ইউরোপীয় প্রচার মাধ্যমগুলো ওই অঞ্চলে বিশেষ করে জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনে উগ্র আইএস জঙ্গিদের হামলাকে কেন্দ্র করে এমনভাবে প্রচার চালাচ্ছে যাতে ইউরোপীয় সমাজে সমগ্র মুসলমানদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরি হয়। বিশেষ করে, ইউরোপে মুসলমানদের উপস্থিতি ও তাদের প্রভাব ক্রমেই বাড়তে থাকায় এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরির জন্য এ ধরনের প্রচারণা কৌশল বেছে নেয়া হয়েছে। পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে ইসলাম বিদ্বেষ সম্পর্কে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ শেইখ রেইহান রেজা আল আজহারি বলেছেন, 'তাদের ভুল তথ্য ও ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণার কারণে উগ্র খ্রিস্টানদের তৎপরতা অনেক বেড়েছে।'
চলতি বছর ২৮ আগস্ট দক্ষিণ সুইডেনের মালমু শহরে একদল উগ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায় পবিত্র কোরআনে অগ্নি সংযোগ করে। এর প্রতিবাদে সুইডেনের প্রায় ৩০০ মুসলমান ওই দিনই বিক্ষোভ করে। মালমু শহরে ডেনমার্কের উগ্র ডানপন্থী দলের নেতা রাসমুস পোলুদানের পরিকল্পিত জনসমাবেশে বাধা দেয়ার ঘটনার পরই কোরআন অবমাননার ওই ঘটনা ঘটে। সমাবেশে অংশগ্রহণে বাধা দেয়ার জন্য রাসমুসকে সীমান্তেই আটকে দিয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী। সমাবেশে যেতে না পেরে ডেনমার্কের উগ্র মুসলিম বিদ্বেষী ওই নেতা তার সমর্থকদেরকে কোরআন শরীফে অগ্নি সংযোগ করার নির্দেশ দেয়। ওই ব্যক্তি এর আগেও কোরআন অবমাননা করে সেসব ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এ কারণে সুইডেন সরকার ডেনমার্কের ওই উগ্রপন্থী নেতাকে দুই বছরের জন্য সুইডেনে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
ইউরোপে ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিবাদ
ইসলাম বিদ্বেষী তৎপরতার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের পর বিতর্কিত ফরাসি ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর পক্ষ থেকে বিশ্ব মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে আবারও ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ করা হয়।
১ সেপ্টেম্বর প্রথমে তাদের ওয়েব সাইটে এ কার্টুন প্রকাশ করা হয় এবং এর পরের দিন সেসব ছবি পত্রিকার কাগজে ছাপানো হয়। ইসলাম অবমাননাকে কেন্দ্র করে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শার্লি এবদোর দফতরে হামলার অজুহাতে ফ্রান্সের আদালতে অভিযুক্ত ১৩ জনের ব্যাপারে রায় প্রকাশিত হওয়ার মাত্র একদিন আগে শার্লি এবদো ম্যাগাজিনে ফের রাসুল(সা.)কে অবমাননা করে ছবি প্রকাশ করা হয়। ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয়তে লেখা হয় এসব ছবি ইতিহাসের অংশ এবং ইতিহাসকে কখনো মুছে ফেলা যায় না।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)র অবমাননা করা থেকে বোঝা যায় উগ্র খ্রিস্টানরা ইসলাম ও বিশ্বনবীর সুমহান মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। এর আগেও তারা বেশ ক'বার এ ধরণের ছবি বা কার্টুন প্রকাশ করেছে।
২০১৫ সালের পর আবারো শার্লি এবদো ম্যাগাজিনের এ ধরনের ন্যক্কারজনক পদক্ষেপের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুসলমানদেরকে উস্কানি দেয়া এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বহি:প্রকাশ ঘটানো। তবে এর বিরুদ্ধে বিশ্বের মুসলিম ব্যক্তিত্বগণ তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এক বিবৃতিতে অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, 'পবিত্র ও নুরানি ব্যক্তিত্ব মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)কে অবমাননা করে ক্ষমার অযোগ্য মহাপাপ করেছে ফরাসি পত্রিকা। তাদের এই পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জাতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হিংসা-বিদ্বেষের বিষয়টি আবারও স্পষ্ট হয়েছে।' তিনি আরও বলেছেন, 'বাক্ স্বাধীনতার অজুহাত দেখিয়ে ফ্রান্সের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ এই মহা অপরাধের নিন্দা পর্যন্ত জানাননি। তাদের এই অজুহাত অগ্রহণযোগ্য ও ভুল। এর মাধ্যমে তারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।' ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, 'ইহুদিবাদী গোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদী সরকারগুলোর ইসলাম বিরোধী কঠোর নীতির কারণে মাঝে মধ্যেই এ ধরণের বিদ্বেষী ঘটনা ঘটছে।'
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশকে বাক্ স্বাধীনতা বলে অভিহিত করেছে। অথচ এ দেশটি কথিত ইহুদি নিধনযজ্ঞ হলোকাস্টের বিরুদ্ধে কথা বলাকে সহ্য করে না। বাক্ স্বাধীনতা ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত হানার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি।#
পার্সটুৃডে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন