ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে ভারত-শাসিত কাশ্মিরের বিশেষ স্বীকৃতি প্রত্যাহার করার বর্ষপূর্তি হবে বুধবার (৫ আগস্ট)। মাঝের এই একটা বছরে কাশ্মিরে ঠিক কী কী পাল্টে গেছে আর কীভাবে তা সম্ভব হয়েছে, তা নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদন করেছেন বাংলা ট্রিবিউনের দিল্লি প্রতিনিধি রঞ্জন বসু। আজ দ্বিতীয় পর্ব।
মাত্র বছর পাঁচেক আগের কথা। কাশ্মিরের ঘরে ঘরে তখন তরুণ-তরুণীদের প্রিয় নাম বুরহান ওয়ানি। সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের কমান্ডার ছিল বছর কুড়ির এই সুদর্শন টগবগে তরুণ। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতেও তার রঙিন উপস্থিতি – ফর্সা গালে হালকা দাড়ির রেশ, হাতে একে ফরটি সেভেন নিয়ে কখনও আপেল বাগানে বিশ্রাম নিচ্ছে, কখনও বা সতীর্থদের সঙ্গে চলছে বন্দুকবাজির মহড়া। সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে সশস্ত্র লড়াইয়ের বিজ্ঞাপন তার মতো কেউ আগে কখনও করতে পারেনি।
ট্রালের দাদাসারা গ্রামের এই তরুণ তখন প্রায় চে গুয়েভারার মতো মর্যাদায় পূজিত হচ্ছেন কাশ্মিরে। ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে’ গোটা কাশ্মির যেন ভাবতে শুরু করেছিল ‘আমিই বুরহান’। আর ২০১৬ সালের ৮ জুলাই গোপন খবরের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী আর পুলিশ মিলে যখন সেই বুরহানকে হত্যা করে, শোকস্তব্ধ কাশ্মির অচল হয়ে ছিল মাসের পর মাস।
শোনা যায়, বুরহান ওয়ানির সাবেক কোনও প্রেমিকাই পুলিশকে তার গতিবিধির হদিশ ফাঁস করে দিয়েছিল।
বুরহান ওয়ানির পর যিনি হিজবুল মুজাহিদিনের নেতৃত্ব পান, সেই রিয়াজ নাইকুরও মৃত্যু হয়েছে ঠিক তিন মাস আগে – আর সেটাও সেনাবাহিনীর গুলিতেই। মহামারি আর লকডাউনের মধ্যে কাশ্মিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘জঙ্গিবিরোধী অভিযান’ চলছে পুরোদমে, আর তারই বলি হয়েছেন রিয়াজ নাইকু। কিন্তু প্রশ্ন হল, বছরের পর বছর ধরে কাশ্মিরের সশস্ত্রপন্থী নেতারা সেখানকার যুবকদের কাছে যে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন, ৩৭০ ধারার বিলোপ সেই প্রবণতায় কি আদৌ কোনও পরিবর্তন আনতে পেরেছে?
পুলওয়ামার একটি গ্রামের প্রবীণ সরপঞ্চ আলতাফ ঠাকুরের দাবি, “কিছুটা তো পেরেছে। আগে আমাদের এলাকায় প্রতি শুক্রবারেই মসজিদে মসজিদে ‘প্রোটেস্ট ক্যালেন্ডার’ বিলি করা হত। মানে কবে কোথায় ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হবে, কোথায় গিয়ে মহল্লার যুবকদের জড়ো হতে হবে সে সব জানানো হত ওই ক্যালেন্ডারে – আর ওগুলোই ছিল হিজবুলসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর রিক্রুটিং গ্রাউন্ড। অথচ গত এক বছরে ক্যালেন্ডারও বিলি হয়নি, আমরাও বিশেষ কোনও প্রতিবাদ দেখিনি বললেই চলে!’
এমনকী শ্রীনগর-সহ বিভিন্ন শহরে কাশ্মিরি যুবকদের পাথর হাতে লড়াইও অনেকটাই কমে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এ বছরের গোড়ায় দেশের পার্লামেন্টে জানিয়েছিল, ২০১৯-র ৫ আগস্ট ৩৭০ ধারা বাতিলের পর থেকে ‘স্টোন পেল্টিং’ বা পাথর ছোঁড়ার ঘটনা তার আগের বছরগুলোর তুলনায় অন্তত ৪৫% কমেছে। মার্চে সারা দেশের সঙ্গে কাশ্মিরেও লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে সেই সংখ্যা আরও অনেক কমে এসেছে।
সাংবাদিক তারিক বাট বলছিলেন, ‘২০১৬ সালেও গোটা কাশ্মিরে ছাব্বিশ শ’রও বেশি স্টোন পেল্টিং নথিভূক্ত হয়েছিল। অথচ চলতি বছরে এরকম দুশ’ ঘটনাও ঘটেছে কি না সন্দেহ। যে কোনও কারণেই হোক, কাশ্মিরের তরুণরা যেন রাস্তায় নেমে পাথর ছোঁড়ার উৎসাহই হারিয়ে ফেলেছে। কেউ কেউ বলেন, আগে পাথর ছুঁড়লে পাকিস্তানি এজেন্টদের কাছ থেকে রোজ পাঁচশ’ রুপি পাওয়া যেত – সেটা নাকি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। বিষয়টা সত্যি কি না বলতে পারব না, তবে পাথর ছোঁড়া যে অনেক কমেছে সেটা দেখাই যাচ্ছে।’
তবে এরসঙ্গে কাশ্মিরের বিশেষ স্বীকৃতি বাতিলের কি আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে? কাশ্মিরের গান্দেরবাল জেলার ডেপুটি কমিশনার শফকাত ইকবালের দাবি, অবশ্যই আছে। বাংলা ট্রিবিউনকে টেলিফোনে তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের জেলায় এলে আপনি বুঝতে পারবেন পরিবর্তনটা ঠিক কোথায় আর কীভাবে হচ্ছে। কাশ্মির সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আসার পর দিল্লি এখানে উন্নয়নের কাজে জলের মতো টাকা খরচ করছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বা স্থানীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচে যে প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর ধরে আটকে ছিল সেগুলোতে ঝড়ের গতিতে এখন কাজ হচ্ছে।’
‘আর এলাকায় সরকারি কাজ হওয়া মানেই স্থানীয় তরুণদের কর্মসংস্থান, ঠিকাদারি পাওয়া ইত্যাদি অনেক কিছু। আর আপনিই বলুন, রোজগারের নিশ্চয়তা থাকলে কে-ই বা জঙ্গিবাদের বিপজ্জনক ও অনিশ্চিত পথে পা বাড়াতে চাইবে?’, পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।
আসলে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ দিয়ে জঙ্গিবাদ বা উগ্রপন্থার আদর্শের মোকাবিলা করা যায় কি না, এই বিতর্ক অনেক পুরনো। শুধু কাশ্মির কেন, পৃথিবীর নানা প্রান্তেই নানা সময়ে এ চেষ্টা হয়েছে – কোথাও তা সফল হয়েছে, কোথাও বা ব্যর্থ। কিন্তু ৩৭০ বিলোপ-পরবর্তী কাশ্মিরে সেই প্রক্রিয়াই এখন আবার শুরু হয়েছে পুরোদমে, উপত্যকার তরুণদের সমাজজীবনের মূল ধারায় নিয়ে আসার একটা জোরালো চেষ্টা চলছে।
প্রয়াত শেখ আবদুল্লা ও তার ছেলে-নাতিরা যে গান্দেরবাল কেন্দ্র থেকে বহুবার জিতে এসেছেন, সেখানকার সরকারি ডিগ্রি কলেজে যেমন গত কয়েক মাসের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে বিরাট লাইব্রেরি, আধুনিক মিলনায়তন, ডিবেট হল, সংস্কৃতি চর্চার হলসহ অনেক কিছু। মানে দিল্লি-মুম্বাইয়ের একটা আাধুনিক কলেজেও যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেই, কাশ্মিরের একটা ছোট্ট জেলা শহরের কলেজেও তার আয়োজন হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা যথারীতি মুগ্ধ।
বারামুলায় ওল্ড ও নিউ টাউনের মধ্যে সংযোগকারী একটা কাঠের ফুটব্রিজ ছিল, যা ২০১৪ সালের বন্যায় ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই কাঠের ব্রিজ পাল্টে এতদিনে আধুনিক ব্রিজ নির্মিত হচ্ছে। ট্রাল-এর বাইশটা গ্রামে সেচের জল জোগাবে, এমন একটা পৌনে দুইশ’ কোটি রুপির লিফট ইরিগেশন প্রকল্প বহু বছর ধরে আটকে ছিল – সেটাও এখন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
কাশ্মিরের অন্যতম প্রধান পর্যটক আকর্ষণ গুলমার্গের তুষারধবল উপত্যকায় গত শীতেই আয়োজিত হয়েছে প্রথম জাতীয় উইন্টার গেমস। সারা দেশের কয়েকশ’ প্রতিযোগী অংশ নিয়েছেন সেখানে। এবং এমন উদাহরণ আরও অজস্র।
তবে কাশ্মিরের তরুণদের জঙ্গিবাদের পথ থেকে সরিয়ে আনতে এই সব উদ্যোগ যথেষ্ট কি না, তার উত্তর এই মুহুর্তে জানা নেই। দুই দশক আগে ‘উন্নয়ন’ দিয়ে কাশ্মিরের মন জয় করার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীও, কিন্তু সত্যি কথা বলতে প্রতিশ্রুত সেই উন্নয়ন সেভাবে কখনও দিনের আলো দেখেনি। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর অবশ্য কেন্দ্র এখন সরাসরি কাশ্মিরের প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ এবং অর্থ খরচেও কোনও কার্পণ্য করা হচ্ছে না – কাজেই এবার সত্যিকারের কোনও পরিবর্তন হলেও হতে পারে বলে দিল্লির বিশ্বাস।
কাশ্মিরের সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় উগ্রপন্থী একটা সময় আসত বারামুলা থেকে। সেই বারামুলার ডেপুটি কমিশনার ড: জি এন ইটু বলছিলেন, ‘৩৭০র বিলোপ একটা পরিবর্তন অবশ্যই এনেছে। কাশ্মিরের তরুণরা এখন জানেন, কেরিয়ার তৈরির জন্য তাদের শুধু শ্রীনগরের ভরসায় থাকতে হবে না – দিল্লি-মুম্বাই-ব্যাঙ্গালোর-হায়দারাবাদের দরজাও কিন্তু তাদের জন্য খুলে গেছে। কাশ্মির ও বাকি ভারতের মধ্যে যে অদৃশ্য একটা দেওয়াল ছিল সেটা যেন এখন পুরোপুরি ভেঙে গেছে বলতে পারেন!’
তবে বুরহান ওয়ানি বা রিয়াজ নাইকুদের যারা এক সময় আদর্শ বলে মনে করতেন, তারাও ঠিক একইভাবে ভাবছেন কি না – সেটা জানার জন্য অবশ্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন