মালয়েশিয়ায় ডিটেনশন সেন্টারে প্রবাসীদের ওপর চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন। সাক্ষাৎকারে এমন তথ্য জানিয়েছেন সেখান থেকে ফিরে আসা একজন। এখন নতুন করে আবার বিপদে পড়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার প্রবাসীদের শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যম আল জাজিরায়। যা নিয়ে এখন মালয়েশিয়ায় তোলপাড় চলছে। তথ্যচিত্রটিতে সেখানকার প্রবাসীদের ওপর নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে। দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রায়হান কবির সেখানে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এরপর থেকেই তাকে গ্রেফতারে মরিয়া দেশটির পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিভাগ। তাকে না পেয়ে তার সঙ্গীদের আটকে রাখার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
মালয়েশিয়ায় অবস্থান করা অন্তত দুই জন বাংলাদেশি শনিবার টেলিফোনে বলেছেন, চরম আতঙ্কে তাদের দিন কাটছে। রায়হান কবিরের তিনজন বন্ধুকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিলেও দুইজনকে এখনো ছাড়েনি। রায়হান কবিরের সন্ধান দিতে তাদের উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। শুধু রায়হান কবিরের বন্ধুদেরই নয়, তার পরিচিত বাংলাদেশিদেরও ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হয়রানির ভয়ে টেলিফোনে কথা বলা ওই দুই জন নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
চার বছর মালয়েশিয়ায় থাকার পর কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছেন নূর মোহাম্মদ আকন্দ সোহেল। দেশে ফেরার আগে তিনি সেখানে চার মাস বন্দি ছিলেন। ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার বাসিন্দা সোহেল দেশটির ‘ডিটেনশন ক্যাম্পের’ বর্ণনা দেন।
বলেন, ‘আমার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আবেদন করি। এরমধ্যেই অভিযানে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে কোন দিন দুই বেলা, কোন দিন এক বেলাও খাবার দিয়েছে। আমাদের অভিভাবক হাইকমিশনের কেউ কোনদিন খোঁজ নেয়নি। আমার মতো বহু বাংলাদেশি সেখানে ডিটেনশনে আছেন। আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না, এই আমলেও পৃথিবীতে এমন কোন আইন আছে যে, এক-দেড়শ' মানুষকে উলঙ্গ করে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে কানধরে উঠবস করায়। মালয়েশিয়াতে সেটা করায়। সবচেয়ে বড় নির্যাতনের নাম রতান (বেত মারা)। আমাদের দেশে গ্রামে গরুকে যেভাবে চার পা ও মুখ বেঁধে ইনজেকশন দেওয়া হয় মালয়েশিয়ায় একইভাবে হাত পা বেঁধে রতান মারা হয়। তিন চার ফুট লম্বা, চিকন বেত দিয়ে পেছনে যখন আঘাত করে তখন চামড়া ছিড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। পরে মাংসসহ উঠে আসে।’
সোহেলের দাবি এমন নির্যাতন বাংলাদেশিদের উপরই বেশি হয়। অন্য দেশের শ্রমিকদের উপর এত নির্যাতন করে না দেশটির কর্তৃপক্ষ ।
আল জাজিরার তথ্যচিত্রে যা আছে
সোহেল নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তার সঙ্গে আল জাজিরার তথ্যচিত্রেরও মিল পাওয়া যায়। প্রবাসী শ্রমিকদের উপর মালয়েশিয়ার নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র উঠে এসেছে সেখানে। দেখানো হয়েছে, কর্মহীন ও খাবার সংকটে থাকা অভিবাসী শ্রমিকদেরকে ঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অভিবাসী নারীদের ছোট ছোট শিশুদের থেকে আলাদা করে মারধর করা হচ্ছে।
তথ্যচিত্রটিতে রায়হান কবির তার পরিচিতদের উপর চালানো হয়রানি ও নিপীড়নের তথ্য তুলে ধরেছেন। এ কারণে এখন তাকে খুঁজছে পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিভাগ। তার ভিসাও বাতিল করা হয়েছে। এমনকি তার সম্পর্কে তথ্য দিতে জনগনের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। সেখানে তিনি এখন অনেকটাই ‘ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল'। তার সুরক্ষার জন্য আল জাজিরা বিবৃতি দিলেও মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন কোন উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ আছে। বরং ওই রিপোর্ট প্রকাশের পর বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে মালয়েশিয়া সরকারের প্রশংসা করে বিবৃতিও দেওয়া হয়েছে।
হাইকমিশনার যা বললেন
দেশটিতে অবস্থান করা বাংলাদেশিদের উদ্বেগের বিষয়ে ঢাকা থেকে টেলিফোনে জানতে চাইলে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘উদ্বেগের কোন কারণ নেই। যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হচ্ছে, তাদের ভিসা রিনিউ করা হবে। এমনকি যারা ডিটেনশন ক্যাম্পে আছেন তাদেরও নতুন কোম্পানিতে চাকরি দেওয়া হবে। আবার যারা করোনার কারণে বাংলাদেশে আটকা পড়েছেন তারাও যেতে পারবেন। মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে।’
রায়হান কবিরের সুরক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কূটনৈতিক রীতি-নীতির আওতায় যা করা দরকার দূতাবাস তা করবে।’
মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা তাদের কার্যক্রমের বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে কিছু তথ্য পাঠিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশি কর্মীদের কোম্পানি পরিবর্তন করার কাজ শুরু হয়েছে। এই সুযোগ আগে ছিল না। করোনার মধ্যেও কোন কর্মীকে মালয়েশিয়া ফেরত পাঠায়নি। বরং যারা ইমিগ্রেশন ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে' আটক আছে তাদের বিভিন্ন কোম্পানিতে নিয়োগ করা হবে। এই প্রক্রিয়া শিঘ্রই শুরু হবে। অবৈধদের বৈধতা দিয়ে কাজে নিয়োগের বিষয়টিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যারা ছুটিতে দেশে গিয়ে ফিরে আসতে পারছে না তাদের আসারও সুযোগ দেবে মালয়েশিয়ান সরকার।
রায়হান কবিরকে নিয়ে উদ্বেগ
আল জাজিরার তথ্যচিত্র প্রকাশের পর মালয়েশিয়া প্রবাসীরা কী ধরনের সংকটে পড়ছেন তা জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘আল জাজিরার রিপোর্টটিতে অভিবাসী শ্রমিকদের আসল চিত্র উঠে এসেছে। আমাদের শ্রমিকরা সেখানে কী অবস্থায় আছে, তার কিছু চিত্র এই রিপোর্ট দেখলে বোঝা যায়। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সাক্ষাৎকার দেওয়ার কারণে রায়হান কবিরকে যেভাবে খোঁজা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে তিনি একজন ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল। তার সুরক্ষার জন্য আল জাজিরা বিবৃতি দিলেও আমাদের দূতাবাস একেবারেই নিরব। অথচ দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া তাদের কর্তৃব্য। রায়হান কবিরতো সাক্ষাৎকার দিয়ে কোন অন্যায় করেননি। তাহলে আমাদের হাইকমিশন মালয়েশিয়ার সরকারের পক্ষে বিবৃতি দিলো, কিন্তু রায়হান কবিরের কথা একটি বারের জন্যেও উল্লেখ করেনি। আমরা আসলে রায়হানকে নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।’
নূর মোহাম্মদ আকন্দ সোহেল জানিয়েছে, গত শুক্রবার মালয়েশিয়ায় এক বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় তারা। বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়ে তিনি একজন কর্মকর্তার কাছে রায়হান কবিরের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেছেন, রায়হান যেটা বলেছে, সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। তার এসব বক্তব্যের দায়দায়িত্ব হাইকমিশন নেবে না। বাংলাদেশিরা দেশটিতে এখন নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলেও সোহেলকে জানিয়েছেন তার বন্ধু।
কিছুই জানে না বিএমইটি
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের কি খোঁজ খবর রাখছে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)? জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক শামসুল আলম বলেন, ‘‘আসলে আমাদের পক্ষে তেমন একটা খোঁজ খবর রাখা সম্ভব না। কারণ সেখানকার হাইকমিশন কোন তথ্য থাকলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেখান থেকে প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় চাইলে তখন আমাদের জানায়। প্রক্রিয়াটা অনেক লম্বা। তাই আমরা খুব একটা খোঁজ খবর রাখতে পারি না।’
আর আল জাজিরার রিপোর্ট বা রায়হান কবিরের ব্যাপারে বিএমইটি কিছুই জানে না বলে স্বীকার করেন তিন।
সূত্র: ডয়চে ভেলে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন