মার্কিন নৌবাহিনীর পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস থিওডোর রুজভেল্টে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ে মন্তব্য করায় ওই জাহাজের ক্যাপ্টেনকে অপসারণ করেছে মার্কিন নৌবাহিনী। করোনা ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে দিন কয়েক আগে মন্তব্য করেন তিনি।
বিভিন্ন রিপোর্টে জানা যায় ওই জাহাজে থাকা অন্তত ১০০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। থিওডোর রুজভেল্টের ক্যাপ্টেন ব্রেট ক্রোজিয়ার তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠিতে মার্কিন সেনাদের মৃত্যু ঠেকাতে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করেছিলেন।
মার্কিন নৌবাহিনী সচিব থমাস মোডলি বলেছেন, ওই কমান্ডার ‘অত্যন্ত দুর্বল মাপকাঠিতে যাচাই করে’ মন্তব্য করেছেন।
বৃহস্পতিবার নৌবাহিনী সচিব থমাস মোডলি সাংবাদিকদের জানান, চিঠিটি মিডিয়ার সামনে ‘ফাঁস করার অভিযোগে’ ক্যাপ্টেন ক্রোজিয়ারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
তিনি বলেন: ‘ওই চিঠিটি এমন একটি ধারণা দেয় যে নৌবাহিনী তার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। এটা এমন একটা ধারণা তৈরি করে যে নৌবাহিনী তাদের কাজ করছে না, সরকার তাদের কাজ করছে না। যেটা একেবারেই সত্য নয়।’
জাহাজটিতে সংক্রমিত হননি, এমন ৪ হাজার ক্রুকে গুয়ামে কোয়ারেন্টিন করা হচ্ছে। সেখানে স্থানীয়দের সাথে সংস্পর্শে না এসে তারা যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারবে বলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপটির গভর্নর জানিয়েছেন।
ক্যাপ্টেন ক্রোজিয়েরের চিঠিতে কী ছিল?
জাহাজের ক্রু'দের আবদ্ধ জায়গায় বসবাস করতে হচ্ছে বলে সেখানে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে বলে ক্যাপ্টেন ক্রোজিয়ের তার চিঠিতে পেন্টাগনকে সতর্ক করেছিলেন।
৩০শে মার্চে লেখা চার পৃষ্ঠার ঐ চিঠিতে তিনি লেখেন: ‘আমরা যুদ্ধের মধ্যে নেই। তাই নাবিকদের মারা যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’
জাহাজ থেকে সংক্রমণমুক্ত ক্রুদের সরিয়ে নিয়ে আলাদা করতে দ্রুত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান ক্যাপ্টেন ক্রোজিয়ার। চিঠিটি পরে স্যান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকলে ছাপা হয়।
মার্কিন কংগ্রেসের সশস্ত্র বাহিনী বিষয়ক কমিটির ডেমোক্রেটিক নেতারা এক বিবৃতিতে বলেন: ‘ক্যাপ্টেন ক্রোজিয়ার নিশ্চিতভাবে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করেছেন, তবে এই সঙ্কটময় সময়ে তাকে অব্যাহতি দেয়া অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করবে, আমাদের বাহিনীর সদস্যদের আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে এবং তাদের প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটাবে।’
তারা আরও বলেন, ইউএসএস থিওডোর রুজভেল্টের কারণে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, পূর্ণ তদন্ত ছাড়া কমান্ডিং অফিসারকে সরিয়ে আনার মাধ্যমে সেই সমস্যার সমাধান হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি দিনদিন ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে ৯৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৮৮ জন। এর মধ্যে শুধু নিউইয়র্কে মারা গেছে ২ হাজার ৫৩৮ জন।
আক্রান্তের সংখ্যায় দেশটি ইতালি, চীন ও স্পেনকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই ভাইরাসে সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৬ জন। এর মধ্যে ১০ হাজার ৪০৩ জন সুস্থ হয়েছে বাড়ি ফিরেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৯ হাজার ৮৭৪ জন। যা একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ২ লাখ ২৮ হাজার ৪০৪ জন আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে ২ লাখ ২২ হাজার ৯৮৩ জনের অবস্থা সাধারণ। বাকি ৫ হাজার ৪২১ জনের অবস্থা গুরুতর, যাদের অধিকাংশই আইসিউতে রয়েছেন।
আমেরিকার শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অ্যান্টনি ফসি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, দেশে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা এক লাখ বা তারও বেশি হতে পারে। এরপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও একই কথা বলেছেন। এদিকে চীন থেকে জরুরি মেডিকেল সরঞ্জাম পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্র্রে। খবর বিবিসি, এএফপি।
যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা নিউইয়র্কে। সেখানে এ পর্যন্ত মারা গেছে ২ হাজার ৫৩৮ জন এবং আক্রান্ত হয়েছে ৯৩ হাজার ৫৩ জন। এছাড়া নগরীতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথমবারের মতো ১৮ বছর বয়সের নিচে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরে অন্য আরও রোগ ছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, করোনা ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু এক লাখ বা তারও বেশি হতে পারে। এবং এ ধরনের কথা প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছেন ট্রাম্প। রবিবার সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে করোনা ভাইরাস নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প একথা বলেন। খবর সিএনএন। মৃত্যুর সংখ্যা এক লাখ বা এর নিচে থাকলে ‘সম্মিলিতভাবে করা খুব ভালো কাজ হবে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এর আগে রবিবার সকালে সিএনএনের টকশো ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ এ যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অ্যান্টনি ফসি (যুক্তরাষ্ট্র্রের ন্যাশনাল অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের পরিচালক) এক মন্তব্যে বলেছিলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র্রে এক লাখ বা তারও বেশি লোক মারা যেতে পারে।
হোয়াইট হাউসের সংবাদ সম্মেলনে ডা. ফসির মন্তব্যের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প ওই স্বীকারোক্তি দেন। সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প জানান, যুক্তরাষ্ট্র্রজুড়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও ‘স্টে অ্যাট হোম’ গাইডলাইন আরও ৩০ দিন বাড়িয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
দুই সপ্তাহ আগে ১৫ দিনের জন্য এ গাইডলাইন ঘোষণা (লকডাউন) করেছিলেন তিনি, যার মধ্যে গণজমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সোমবার ওই সময়সীমা শেষ হয়। গত সপ্তাহে ট্রাম্প ১২ এপ্রিলের ইস্টারের পর্বের সময় দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এদিনের সংবাদ সম্মেলনে আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন তিনি।
তিনি জানান, কভিড-১৯ এ সম্ভাব্য মৃত্যুর সংখ্যা সম্পর্কে এদিন (রবিবার) তিনি ‘সবচেয়ে সঠিক’ ও ‘বিশদ’ তদন্ত ও বিশ্লেষণ প্রতিবেদন পেয়েছেন। ট্রাম্প বলেন, ‘যদি আমরা কিছু না করি’ তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ট্রাম্প বলেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারে। বিজয় অর্জিত হওয়ার আগেই জয় ঘোষণার চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। আপনারা যত ভালো করবেন, তত দ্রুত এই দুঃস্বপ্ন শেষ হবে।
উল্লেখ্য, করোনা ভাইরাসে পুরো বিশ্ব নিরব, নিস্তব্ধ। বিশ্ব গ্রাম ধারণায় যেখানে রাত-দিনের পার্থক্য করাই দুষ্কর ছিল। সেখানে সমগ্র বিশ্বই ঘরবন্দী। চারদিক শুনশান, জনশূন্য। যেন পৃথিবী আজ এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য হলেও বিশ্বজুড়ে করোনায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ৯৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা এ যাবৎ একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ১৬৬।
এই ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৭৯ হাজার ৭৪৭ জন। এটিও একদিনে আক্রান্তের সংখ্যায় সর্বোচ্চ। এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ১৫ হাজার ৫৯ জন। এর মধ্যে ২ লাখ ১২ হাজার ১৮ জন সুস্থ হয়েছে বাড়ি ফিরেছেন।
এছাড়া বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ৭ লাখ ৪৯ হাজার ৮৫৭ জন আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭ লাখ ১২ হাজার ১৬১ জনের অবস্থা সাধারণ। ৩৭ হাজার ৬৯৬ জনের অবস্থা গুরুতর, যাদের অধিকাংশই আইসিউতে রয়েছেন।
এদিকে করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত ইতালিতে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৩ হাজার ৯১৫ জন। স্পেনে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ৩৪৮ জন। যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজার ৭০ জনের। ফ্রান্সে ৫ হাজার ৩৮৭ জন। চীনে ৩ হাজার ৩১৮ জন। ইরানে ৩ হাজার ১৬০ জন। যুক্তরাজ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজার ৯২১ জনে দাঁড়িয়েছে।
এ রোগের কোনো উপসর্গ যেমন জ্বর, গলা ব্যথা, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, শ্বাসকষ্টের সঙ্গে কাশি দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জনবহুল স্থানে চলাফেরার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বাড়িঘর পরিষ্কার রাখতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে ফিরে এবং খাবার আগে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। খাবার ভালোভাবে সিদ্ধ করে খেতে হবে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন