মহামারী ঘোষিত করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। এ ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় আছে ইতালি। দেশটিতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। মৃত্যুর সংখ্যায় সর্বোচ্চ ইউরোপের এই দেশটি। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। গোটা দেশ লকডাউন, তুবও করোনার প্রকোপ কমছে না। দেশটিতে করোনায় মৃতের হার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বিশেষজ্ঞরাও। প্রশ্ন হচ্ছে, বাকি দেশগুলোর চেয়ে ইতালিতে মৃত্যুর হার এত বেশি কেন?
ইতালিতে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ৭৭৯ জন। যা বাকি দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। ইতালিয়ান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের সভাপতি প্রফেসর ওয়াল্টার রিকিয়ার্ডি বলছিলেন, বয়স্ক মানুষ ইতালির মৃত্যু হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। বয়স্ক লোকদের দেশ হিসেবে বিশ্বে ইতালির অবস্থান দ্বিতীয়। জাপানের পরই তাদের অবস্থান। যাকে ধরা হচ্ছে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ।
প্রফেসর রিকিয়ার্ডি বলেন, হাসপাতালে যেসব রোগী আছেন তাদের বেশির ভাগই যথেষ্ট বয়স্ক। যাদের গড় বয়স ৬৭ বছর, যা চীনে ছিল ৪৬। বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণেই করোনা ইতালিতে অধিক প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।
কয়েকদিন আগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইতালিতে আক্রান্তের ৪০ শতাংশ এবং মৃতের ৮৭ শতাংশই হচ্ছে ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্ক লোকদের যারা আক্রান্ত তাদের হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যসেবায় অতিমাত্রায় চাপ সৃষ্টি করছে।
পাশাপাশি মৃত্যুহার বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে রিকিয়ার্ডি আরো একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। তার মতে, হাসপাতালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে কেবল করোনা ভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে বলে ধরে নিচ্ছেন ডাক্তাররা। যেখানে ডেথ সার্টিফিকেট অনুসারে কেবল ১২ শতাংশ লোকের মৃত্যুর জন্য সরাসরি করোনা ভাইরাস দায়ী। বাকি ৮৮ শতাংশের ন্যূনতম একটি ভিন্ন রোগের ইতিহাস রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দুই বা তিনটিও আছে।
অবশ্য এর মানে এই নয় যে কভিড-১৯ রোগীর মৃত্যুতে কোনো ভূমিকা রাখছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের ত্রুটিও দেশটির মৃত্যুহার বাড়ার কারণ হতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ইতালির নিশ্চিত আক্রান্তের যে সংখ্যা, তার সর্বমোট আক্রান্তের ব্যাপারে সুনিশ্চিত কোনো চিত্র তুলে ধরতে পারছে না।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ইউরোপিয়ান পাবলিক হেলথের প্রফেসর মার্টিন ম্যাককি বলেন, দেশটি এখন পর্যন্ত মৃদু লক্ষণসম্পন্ন কতজন লোক আছে তার কোনো ধারণা দিতে পারেনি।
যদি পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে আরো এমন রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হয় যাদের কোনো লক্ষণ ধরা পড়েনি কিন্তু আক্রান্ত, তবে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে লক্ষণবিহীন করোনা আক্রান্ত রোগীরাই অন্য রোগীদের মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ হতে পারেন। তবে এখন পর্যন্ত ঠিক কতজন এমন মৃদু লক্ষণ বা লক্ষণবিহীন রোগী করোনা ছড়িয়ে যাচ্ছেন, তা নিয়েও কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। আর এ কারণে ইউরোপ নিয়ে এখন পর্যন্ত তুলনায় আসার সময় হয়নি বলেও মনে করেন তিনি।
ইতালিতে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার পেছনে আরো কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যাদের মাঝে ধূমপান ও দূষণ উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে লম্বার্ডিয়া এলাকায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুকে প্রভাবিত করছে অঞ্চলটির ভয়াবহ বায়ুদূষণ। এছাড়া করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর আধিক্যের কারণে ইতালির স্বাস্থ্য খাতও এখন বিপর্যয়ের মুখে। যার ফলে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতেও সমস্যা হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তারদের একসঙ্গে ১২০০ রোগীর সেবা দিতে হচ্ছে।
রোগীদের এ চাপের ফলে সবচেয়ে খারাপ যে বিষয়টি হচ্ছে তা হলো স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন এবং তাদেরও দ্রুত আইসোলেটেড করে ফেলতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত এ সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।
প্রফেসর ম্যাককি ইতালিতে ভয়াবহ অবস্থার জন্য যে তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন তার মাঝে স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টিও আছে। খবর দ্য টেলিগ্রাফ।
উল্লেখ্য, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ১৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৩ হাজার ৯৫ জন।
এই ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ২৪ হাজার ৫৬৫ জন। এর মধ্যে ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৬ জন সুস্থ হয়েছে বাড়ি ফিরেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৮ হাজার ২৮৫ জন।
এছাড়া বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৪৭২ জন আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ১১ হাজার ৭৫৩ জনের অবস্থা সাধারণ। বাকি ২৬ হাজার ৭১৯ জনের অবস্থা গুরুতর, যাদের অধিকাংশই আইসিউতে রয়েছেন।
করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত ইতালি। ইতালিতে মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়েছে। এখন পর্যন্ত সেখানে মারা গেছেন ১০ হাজার ৭৭৯ জন।ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি স্থান চীনকেও পেছনে ফেলেছে স্পেন। সেখানে মৃতের সংখ্যা ৬ হাজার ৮০৩ জন। আর যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৪৮৯ জন। যুক্তরাজ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ২২৮ জনে দাঁড়িয়েছে।
এ রোগের কোনো উপসর্গ যেমন জ্বর, গলা ব্যথা, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, শ্বাসকষ্টের সঙ্গে কাশি দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জনবহুল স্থানে চলাফেরার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বাড়িঘর পরিষ্কার রাখতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে ফিরে এবং খাবার আগে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। খাবার ভালোভাবে সিদ্ধ করে খেতে হবে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন