চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন ও তাদের জোরপূর্বক আটকে রাখা নিয়ে একটি গোপন নথি ফাঁস হয়েছে। ফাঁস হওয়া এই নথিতে জিনজিয়াংয়ের বন্দিশিবিরে আটকে রাখা উইঘুর মুসলিমদের ভাগ্য কীভাবে নির্ধারণ করা হয়; সেসবের বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
মার্কিন বার্তাসংস্থা এসোসিয়েট প্রেসের (এপি) হাতে ফাঁস হওয়া নথির একটি কপি এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশের বন্দিশিবিরে আটক ৩১১ জন উইঘুর মুসলিম এবং দেশের বাইরে থাকা তাদের ৩ হাজারের বেশি আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং বন্ধু-বান্ধবের বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এতে ওই ব্যক্তিদের নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয় নম্বর, আটক করার তারিখ, অবস্থানের পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় পরিচয় ও প্রত্যেক পরিবারের বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এছাড়া কেন তাদের আটক করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে ছাড়া পাবেন কি-না সে ব্যাপারেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ওই নথিতে আটককৃতদের নামের পাশে লিপিবদ্ধ। তবে দেশটির সরকারের কোন বিভাগ এই নথি তৈরি করেছে সে ব্যাপারে পরিষ্কার কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, নথিতে ঠাঁই পাওয়া উইঘুর মুসলিমদের প্রত্যেকদিনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বিষয়গুলোও বিস্তারিত রয়েছে। ১৩৭ পৃষ্ঠার কলাম ও সারিতে লিপিবদ্ধ এই গোপন নথিতে উইঘুর মুসলিমরা কীভাবে প্রত্যেকদিন নামাজ আদায়, পোশাক পরিধান, দাড়ি রাখা, নারীরা বোরকা পরেন কি-না, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আচরণ কেমন সেসবের বর্ণনাও রয়েছে।
চীনের বিরুদ্ধে উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে। চীন বলছে, তারা সন্ত্রাসবাদ এবং ধর্মীয় চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।
ওয়াশিংটনের ভিকটিমস অব কমিউনিজম মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ ফেলো ও জিনজিয়াংয়ে চীনের নীতিবিষয়ক বিশ্বের অন্যতম বিশেষজ্ঞ ডা. অ্যাদ্রিয়ান জেঞ্জ মনে করেন, সর্বশেষ ফাঁস হওয়া নথিটি সত্য। তিনি বলেন, বেইজিং যে প্রচলিত ধর্মীয় চর্চাগুলোকে সক্রিয়ভাবে দমন এবং শাস্তি দিচ্ছে সেবিষয়টি অসাধারণ এই নথিতে উঠে এসেছে। এটি এখন পর্যন্ত আমার দেখা শক্তিশালী প্রমাণ।
নথিতে নম্বর ফোর ট্রেইনিং ক্যাম্প নামের একটি ক্যাম্পের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; যা জেঞ্জ শনাক্ত করেছেন। গত বছরের মে মাসে চীন সরকারের আয়োজনে এই ক্যাম্পটি একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সফর করে বিবিসি।
নতুন ফাঁস হওয়া এই নথিতে আটক উইঘুরদের পরিবারদের শনাক্ত করে তাদের বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে বিভক্ত করা হয়েছে। এতে কিছু কিছু পরিবারকে বিশ্বাসযোগ্য অথবা বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং তাদের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে, স্বাভাবিক এবং ভালো হিসেবে।
পরিবারে ধর্মীয় চর্চার বিষয়গুলোও আলাদা আলাদা শ্রেণিতে বিভক্ত করেছে। এতে কিছু পরিবারে হালকা অথবা ভারী ধর্মীয় চর্চা বিদ্যমান আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব পরিবারে ধর্মীয় চর্চা বেশি, সেসব পরিবারের সদস্যদের আটক কেন্দ্র থেকে না ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ডা. অ্যাদ্রিয়ান জেঞ্জ বলেন, প্রত্যেক মানুষকে এভাবে অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করার মাধ্যমে চীন সরকারের মানসিক দৈন্যতা নির্দেশ করছে।
চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের বিরুদ্ধে চীন সরকার কঠোর অভিযান পরিচালনা করছে বলে বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো নিন্দা প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, চীন সরকার কমপক্ষে ১০ লাখ উইঘুর মুসলিমকে জিনজিয়াংয়ের আশ্রয় কেন্দ্রে আটকে রেখেছে। চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় এই প্রদেশে অন্তত এক কোটি সংখ্যালঘু উইঘুরের বসবাস। এর মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ তুর্ক মুসলিম। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নিপীড়ন এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এই মুসলিমরা।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চীন সরকারের বিরুদ্ধে জিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনে পদ্ধতিগত অভিযান পরিচালনার অভিযোগ করেছে। একই সঙ্গে উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনের নিপীড়ন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন