নরেন্দ্র মোদি কখনও ছাত্র ছিলেন না, তাঁহার পক্ষে ছাত্রছাত্রীদের সহমর্মী হওয়া সম্ভব নয়। ক্রুদ্ধ মন্তব্যটি প্রবীণ অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহের।
তিনি জানিয়েছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ অপেক্ষা তাঁহার ক্রোধ বেশি হচ্ছে। ক্রোধের প্রধান কারণ ভারতের বর্তমান শাসকদের অসহিষ্ণু ও আধিপত্যবাদী আচরণ, অধুনা প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে যে আচরণ অতিমাত্রায় প্রকট। প্রধানমন্ত্রীর ভক্তবৃন্দ নিশ্চয়ই বক্তার প্রতি নূতন করে কুপিত হবেন, অত্যুৎসাহীরা হয়তো তাঁহাকে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ বা আদেশও দেবেন।
ভক্তরা ভক্তিমার্গে বিচরণ করুন, নাসিরুদ্দিনের মন্তব্যটি নিয়ে গভীরতর আলোচনার সুযোগ আছে।
বর্তমান ভারতে সেই আলোচনা প্রয়োজনীয়ও বটে।
প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী আক্ষরিক অর্থে কখনও ছাত্র ছিলেন না, এমন কথা নিশ্চয় নাসিরুদ্দিন শাহ বলতে চাননি।
শ্রীযুক্ত মোদির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌড় সম্পর্কে নানা সংশয় সুবিদিত। সেই সকল জল্পনা হয়তো নাসিরুদ্দিনের মন্তব্যে ছায়া ফেলেছে। কিন্তু সেই কাসুন্দি ঘাঁটার প্রয়োজন নেই। বৃহত্তর সত্য এই যে, ছাত্রজীবন বলতে যা বুঝায়, বিশেষত সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ছাত্রছাত্রীদের যে ভূমিকা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুগে প্রাসঙ্গিক হয়েছে, এই মুহূর্তে ভারত জুড়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নরেন্দ্র মোদির জীবনে তেমন ভূমিকার কোনও ইতিবৃত্ত শোনা যায় নি।
ভারতের অন্য বহু রাজনীতিকের জীবন কাহিনিতে তাঁহাদের ছাত্রাবস্থার একটি বড় স্থান ছিল, বিশেষত ছাত্র রাজনীতির সোপান অনেকেরই বড় হওয়ার পথ। মোদি তার অন্যতম ব্যতিক্রম।
দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষা অর্জন না করলে কেউ পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারে না। — এমন কোনও ‘এলিট’ পক্ষপাত, আশা করা যায়, নাসিরুদ্দিনের মন্তব্যে নেই। যদি থাকে তবে সেই পক্ষপাত অবশ্যই আপত্তিকর।
কিন্তু নাসিরুদ্দিন শাহের সমালোচনার একটি বৃহত্তর তাৎপর্য আছে। মানুষের জীবনে, বিশেষ করে তার মানসিক গঠনের বিবর্তনে সচেতন এবং সক্রিয় প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্রজীবনের ভূমিকা কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে ও তাহার সংশ্লিষ্ট পরিমণ্ডলে তরুণ তরুণীদের সম্মুখে একই সঙ্গে একাধিক নূতন ভুবনের দ্বার খুলে যায়।
এক দিকে উচ্চতর শিক্ষার প্রশস্ত ও ক্রমপ্রসরমাণ বিশ্বে বিহারের সুযোগ, অন্য দিকে সমাজজীবনের বিবিধ ঘটনায় ও আলোচনায় যোগদানের সুযোগ আসে। এবং এই সমস্ত বিষয়েই সমন্বিতভাবে মুক্ত চিন্তার অনুশীলন করতে পারেন ছাত্রছাত্রীরা। অনেক সময়েই শিক্ষকরাও তাঁদের সেই অনুশীলনে শরিক হন।
এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়্য়েই নাগরিক চেতনার বিকাশ ঘটে, ঘটিয়া চলে। অবশ্যই এই প্রক্রিয়ায় প্রায়শই রকমারি ভেজাল মিশিয়া থাকে, বিশেষত ক্ষুদ্র দলীয় রাজনীতি ছাত্রছাত্রীদের চিন্তাচেতনায় ও কাজকর্মে অনুপ্রবেশ করে। কিন্তু সেই যুক্তিতে মানসিক উত্তরণের সম্ভাবনাকে কখনওই অস্বীকার করা চলে না।
অনেকের ক্ষেত্রেই সেই সম্ভাবনা চরিতার্থ হয় না, তাঁরা নিছক পরীক্ষা পাশ করে অথবা না করে পরবর্তী জীবনে প্রবেশ করেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্রজীবনে যিনি বঞ্চিত, ওই সম্ভাবনাটি তাঁহার অধরা থেকে যায়।
নরেন্দ্র মোদির মতো মানুষের জীবনে অপ্রাপ্তি বা অসম্পূর্ণতার আরও একটি বিশেষ কারণ থাকা সম্ভব। সঙ্ঘ পরিবারের তদ্গত সদস্য হিসাবে তাঁরা এক ধরনের ‘শিক্ষার মধ্য দিয়ে তৈরি হন। তা কেবল সঙ্কীর্ণ অসহিষ্ণু মতাদর্শের পাঠ নহে, সেই শিক্ষার বদ্ধ পরিসরে বসে বিনা প্রশ্নে গুরুবাক্য মেনে নিতে হয়, তা তোতাকাহিনির এক উৎকট সংস্করণ।
এই শিক্ষার বিষয় ও পদ্ধতি কেবল মুক্তচিন্তার সামর্থ্যই নষ্ট করিয়া দেয় না, যে কোনও বৈচিত্রের প্রতি ষোলো আনা অসহিষ্ণু করে তোলে।
নাসিরুদ্দিন এই গভীরতর সমস্যাটির কথা বলেন নি। হয়তো ভাবেন নি। তাঁর ক্রোধ হয়তো তাঁহার ভাবনাকে সেই গভীরে পৌঁছাইতে দেয়নি। তাই ক্রোধের স্বভাব। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব থাকলেও মানুষ সামাজিক জীবন হতে মুক্তচিন্তা এবং সহিষ্ণুতার রসদ সংগ্রহ করিতে পারেন, বহু মানুষ তাহা করে চলছে। তাহা না হলে দেশ চলত না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ এই দেশে আজও কয় জনেরই বা হয়? নরেন্দ্র মোদিদের দুর্ভাগ্য বোধ করি আরও অনেক বেশি।
কে দেশপ্রেমী কে দেশদ্রোহী, তা নিয়ে দড়ি-টানাটানির মধ্যেই এসে পড়ল প্রজাতন্ত্র দিবস, যা দেশের প্রজাদের ভালর কথা বলে, রাজাদের নয়। অবশ্য হিসেব মতো গণতন্ত্রে রাজা থাকারও কথা নয়, কিন্তু তা কে বুঝছে? কেউ অবাধ্য প্রজাদের গুলিগোলা দিয়ে উড়িয়ে দিতে উৎসুক, কেউ বেয়াড়া ছাত্রছাত্রীদের অন্য দেশে চালান করতে উদ্গ্রীব। সাতেপাঁচে না থাকা গেরস্থ অবশ্য ছুটির দিনে মাংস খেয়ে তৃপ্ত, কিন্তু তা কিসের মাংস যাচাই করতে তদন্ত-কমিটি বাড়িতে ঝাঁপালে?
পূর্বপশ্চিমবিডি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন