কাশ্মীরে আতঙ্ক কাটেনি, বাগানেই পচছে আপেল
ভারতে নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সবুজ বাগানে রক্তের ছিটা! দূর থেকে প্রথমটায় তেমনই মনে হয়।
আসলে তা রক্ত নয়। লালরঙা আপেল মাটিতে এ দিক ও দিক ছড়িয়ে আছে। শ্রমিকের অভাবে বাগানেই পচছে আপেল।
কাশ্মীরের শোপিয়ান এলাকার বিশাল আপেল বাগানগুলো অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই গমগম করে।
অন্য রাজ্যের ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেন। শোপিয়ান ছাড়াও পুলওয়ামা, বিজবেহরা, সোপোরের আপেল এসে জমা হয় এই পাইকারি বাজারে। দিনে অন্তত ৩০০ ট্রাক আপেল রওনা হয় দেশ-বিদেশে।
কিন্তু গত ৫ আগষ্ট সংবধান থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর থেকে কাশ্মীরজুরে গোমোট পরিবেশ, অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা।
নিরাপত্তার অভাবে আপেলবাগানগুলোতে শ্রমিকরা আসছে না। বাগান-মালিক আমির হুসেনের গলায় হতাশা। রস জমলেই আপেল ভারী হয়ে গাছ থেকে পড়ে যায়।
আর মাটিতে পড়লেই সব নষ্ট। ও আর বিক্রি হবে না। কিন্তু এ বছর ফল পাড়ারই লোক নেই। বেচবই বা কোথায়?
কাশ্মীরের আপেল বাগানে এ বার সত্যিই রক্তের দাগ। ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ হওয়ার পরে ১০০ দিন কেটে গিয়েছে। প্রথমে ছিল কারফিউ।
কারফিউ শিথিল হলে জঙ্গিরা পোস্টার সেঁটে হুঁশিয়ারি দিল, এ বছর আপেল ব্যবসা বন্ধ থাকবে। এ দিকে কাশ্মীরের ‘অ্যাপল সিটি’ শোপিয়ানের গাছে গাছে লাল-সবুজ-সোনালি রঙের আপেল আসতে শুরু করেছে। আমির হুসেনের কপালে তখন থেকেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। এ বার আপেল বিক্রি হবে তো? কিন্তু শোপিয়ানের আপেলে যে রক্তের ছিটা লাগবে, তা আমিরও ভাবেননি।
আপেল চাষি মহম্মদ আশরফ দারের হত্যা দিয়ে শুরু। এর পর শোপিয়ানেই রাজস্থানের ট্রাকচালক মো. শরিফ খান জঙ্গিদের হাতে খুন হন।
তার পর আবার শোপিয়ানেই আপেল ব্যবসায়ীর উপরে হামলায় মারা যান পঞ্জাবের চরণজিৎ সিংহ। জঙ্গিরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ১৮ জন ভিন্ন রাজ্যের শ্রমিককেও বন্দুকের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাশ্মীর ছেড়ে পালানোর হুঁশিয়ারি দিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু পুলওয়ামায় ইটভাটার শ্রমিক সেন্থি কুমার বা মুর্শিদাবাদ থেকে কুলগামে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যাওয়া পাঁচ বাঙালি শ্রমিক রক্ষা পাননি। অন্য রাজ্যের শ্রমিকরাই কাশ্মীরের বাগানে আপেল পাড়ার কাজ করেন। প্রাণের ভয়ে তারা কাশ্মীর ছাড়তে শুরু করায় আপেল পাড়ারই লোক নেই। তাই বউ-ছেলেকে নিয়ে আমির নিজেই হাত লাগিয়েছেন।
শোপিয়ান ছাড়াও পুলওয়ামা, বিজবেহরা ও সোপোর এলাকার আপেল বাগানগুলোতে শুনশান নীরবতা।
৫ অগস্টের পর থেকে এক ট্রাক আপেলও বের হয়নি। জঙ্গিদের ভয়ে আপেল চাষি বা ব্যবসায়ী কেউই মান্ডির পথ মাড়াচ্ছেন না।
৮০ টাকা কেজি দামের কাশ্মীরের সেরা আপেল ২৫-৩০ টাকা দরে বেচে দিতে হচ্ছে রাতের অন্ধকারে।
আর অন্যদিকে, কারফিউ ওঠার পর থেকে সেনা-পুলিশের জওয়ানরা এসে চাপ দিচ্ছে, দিনের বেলা মান্ডিতে গিয়েই আপেল বেচতে হবে। দেখাতে হবে, সব স্বাভাবিক!
শুধু আপেল নয়। ৩৭০ ধারা বাতিলের ধাক্কা লেগেছে পর্যটন থেকে হস্তশিল্প, ফলের রস থেকে তথ্যপ্রযুক্তি— কাশ্মীরের অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই।
কাশ্মীর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ়ের সভাপতি শেখ আশিকের মতে, গত ১০০ দিনে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
কাজ হারিয়েছেন অন্তত ১ লাখ কর্মী। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কাশ্মীর ট্রেডার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো. ইয়াসিন খানও এখন গৃহবন্দি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন