গত ৫ আগষ্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫/এ রাজ্যসভায় বিলুপ্তির পর শ্রীনগরের সোরায় নামাজের পর বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সেই বিক্ষোভের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র কাশ্মিরসহ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এমনকি দুনিয়ার মুক্তিকামী ও মানবতাবাদী মানুষের মধ্যে।
৩৭০ ধারা এবং ৩৫/এ হচ্ছে একটা শর্ত ভিত্তিক চুক্তি। ভারত রাষ্ট্রের সাথে স্বাধীন প্রিন্সলি স্টেইট জম্মু কাশ্মির সম্পূর্ন সায়ত্বশাসন, নিজস্ব পতাকা ও সংবিধান ঠিক রেখে যুক্ত হয়েছিলো। জওহরলাল নেহরুর উপস্থিতিতে শ্রীনগর তথা কাশ্মিরকে ভারতের অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৩৭০ ধারা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর। এই ধারাবলে জম্মু ও কাশ্মিরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। এই ধারা বলে ওই রাজ্যে সংসদের ক্ষমতা সীমিত রাখা হয়। সেই সাথে কোন কেন্দ্রীয় আইন প্রয়োগ করতে চাইলে রাজ্যের মত ছাড়া সম্ভব নয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় থেকেই এই বিশেষ ধারাটি কার্যকরী হয়।
স্বাধীনতার পর প্রায় ৬০০টি রাজন্য পরিচালিত রাজ্যের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করা হয়। ওই আইনে তিনটি সম্ভাবনার কথা রয়েছে। প্রথমত, স্বাধীন দেশ হিসেবে থেকে যাওয়া; দ্বিতীয়ত, ভারতের যোগদান; তৃতীয়ত, পাকিস্তানে যোগদান। এ ব্যাপারে কোনও লিখিত ফর্ম না থাকলেও, কী কী শর্তে এক রাষ্ট্রে যোগদান করা হবে, তা রাজ্যগুলি স্থির করতে পারত। অলিখিত চুক্তি ছিল। যোগদানের সময়কালীন প্রতিশ্রুতি রক্ষিত না হলে, দু’পক্ষই নিজেদের পূর্বতন অবস্থানে ফিরে যেতে পারবে। তাই ভারত চাইলেই এককভাবে এই চুক্তি বাতিল করতে পারেনা। চুক্তি ভঙ্গ, জবর দখল কিংবা কাশ্মিরিদের মতামতকে উপেক্ষা করা সম্পূর্ণ বেআইনী ও বেইমানী। কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তানের মতামত অথবা পাকিস্তান ভারত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা উল্লেখ আছে। আর সেটা যদি ভারত না করতে চায় তাহলে জাতিসংঘের অধিনে কাশ্মিরে গণভোট দিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
কিন্তু ভারত পাকিস্তানের সাথে আলোচনার প্রয়োজন মনে করেনি, ১৯৪৯ সালের শর্ত ভিত্তিক চুক্তিকে মর্যাদা দেয়নি, কাশ্মিরিদের মতামতকে অগ্রাহ্য করেছে, আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়েছে, সিমলা চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বিরোধীতার মুখে নির্লজ্জভাবে রাজ্যসভায় ৩৭০ ও ৩৫/এ বাতিল করে কেন্দ্রের শাসনের আওতায় নিয়ে এসেছে।
জোরপূর্বক ধারা বাতিল করার প্রস্তুতি হিসেবে কাশ্মীর উপত্যকায় ৭ লাখ সেনা মোতায়েন করেছে বিজেপি সরকার। গত ৭০ বছর ধরেই ভারত অনানুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির লঙ্ঘন করে আসছে আর কাশ্মিরিরা আজাদির আন্দোলন করছে।
জোরপূর্বক ধারা বাতিল করার প্রস্তুতি হিসেবে কাশ্মীর উপত্যকায় ৭ লাখ সেনা মোতায়েন করেছে বিজেপি সরকার। গত ৭০ বছর ধরেই ভারত অনানুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির লঙ্ঘন করে আসছে আর কাশ্মিরিরা আজাদির আন্দোলন করছে। কাশ্মিরি প্রো-ইন্ডিয়ান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যারা মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন তারাও আজ বন্দি। যারা মনে করতেন নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতের সাথে থাকা উত্তম। এরা সব সময় কাশ্মিরের আজাদি আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহের প্রয়াস চালিয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দালালিতে শেষ রক্ষা হয়না এটা ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম।
এখন কাশ্মিরে কারফিউ জারি রয়েছে। মোবাইল, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যোগাযোগ, স্কুল কলেজ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার বন্ধ রয়েছে। সরকারি অফিসগুলো পরিণত হয়েছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে যুবক যুবতীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গণধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাট চলছে। কিন্তু কোন নিউজ কভার করতে দিচ্ছেনা মোদি সরকার। কিছু কিছু নিউজ লিক হচ্ছে বিভিন্ন স্যোশাল মিডিয়ায়।
আজাদির জন্য প্রতিরোধের খবর চেপে যাচ্ছে ভারতের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলো। সমগ্র কাশ্মিরে স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে, বিক্ষোভে ফুসছে কাশ্মীরি জনতা। এরই মধ্যে আলাদা করে নিজেকে পরিচয় করিয়েছে সোরা সিটি।
সোরা শহরটি দিল্লী থেকে ৮৫৮ কিলোমিটার এবং মুম্বাই থেকে ২২০০ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। এটি রাজধানী শ্রীনগরের লালচক থেকে প্রায় সাড়ে এগারো কিলোমিটার উত্তরে । সোরা হচ্ছে শিক্ষা, চিকিৎসা ও ধর্মীয়ভাবে কাশ্মিরের প্রধানতম শহর। এর পশ্চিমে পরিবেষ্টিত নয়নাভিরাম এ্যাঙ্কার লেক। ছবির মত সুন্দর শহরটিতে ঢোকার জন্য তিনদিকে ডজন খানেক রাস্তা আছে। কাশ্মিরি ও উর্দু হচ্ছে সোরার প্রধান ভাষা। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক কারণে পাকিস্তানীদের সাথে তাদের মিল রয়েছে। সোরার জনগণ নিজেদেরকে ফিলিস্তিনের গাজার সাথে তুলনা করছেন। দখলদার ভারতীয় বাহিনী মাত্র ১৫ হাজার জনগনের নগরী সোরায় প্রতিরোধের মুখে প্রবেশ করতে পারেনি এখন পর্যন্ত।
স্টিল শিট, কাঠ, ইট পাথর ও খন্দক তৈরি করে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে নিজেদের। প্রায় ৯০০ জন স্বাধীনতাকামী জওয়ান ২৪ ঘন্টা শিফট করে পাহারা দিয়ে চলেছে। ইট, লাঠি, বল্লম আর পাথর হাতে বুক চিতিয়ে প্রতিরোধ করছে গো-সেনাদের। এ যেন পাথর হাতে কাশ্মিরি আবাবিল, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জীবনবাজি রেখে পাহারা দিয়ে চলেছে। সোরায় প্রতিরোধের মুখে ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনী এখনো প্রবেশ করতে সক্ষম হয়নি। হয়তো ভারতীয় সেনারা প্রবেশ করবে সেখানে তবে বিশ্বাবাসীয় কাছে সোরাবাসীর হার না মানা আজাদি আন্দোলনের ডাক পৌঁছে যাবে। মানবতাবাদী মানুষেরা কাশ্মিরিদের আজাদি আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা দিয়েছে। খোদ ভারতীয়রাও বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে।
ইতিহাসবিদ কিংশুক চ্যাটার্জি’র মতে, ৩৭০ ধারার ভিত্তি নিহিত আছে ভারতের সঙ্গে কাশ্মিরের সংযুক্তিকরণের ইতিহাসে, ফলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মোটেই সহজ নয়। যে শর্তের ভিত্তিতে সে চুক্তি সই হয়েছিল, ভারত সরকার একতরফাভাবে বলতে পারে না যে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে, তাই আমরা সেই শর্তগুলো আবার নতুন করে বিবেচনা করবো।
কিংশুক চ্যাটার্জি আরও বলছেন, ‘‘যদি ভারতের একশো কোটি মানুষও বলে কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আর কাশ্মিরের মানুষ সে কথা না মানে, তাহলে কিন্তু আইনি পথে বা গণতান্ত্রিক পন্থায় ভারত সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অবশ্য গায়ের জোরে হয়তো সম্ভব।’’ তবে গায়ের জোরে কোন কিছু ধরে রাখা যায়না। আন্দোলনের জাতি কাশ্মিরিদের দমিয়ে রাখা সম্ভব না। কাশ্মিরের সাথে বর্ডার আছে পাকিস্তান, চীন, আফগানিস্তানের। পাকিস্তান সরাসরি এবং আফগানিস্তানের জিহাদি মুজাহিদিনদের সহযোগিতা কাশ্মিরিরা পাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। বিজেপির আধুনিক রিপাবলিক বিরোধী কল্পিত সাম্রাজ্যবাদী রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে কাশ্মিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে।
আর কাশ্মির প্রজেক্ট যদি বিজেপি ফেইল করে অথবা দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধের দিকে যায় তবে এইটা সিসটার্সের স্বাধীনতাকামীরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে নাগাল্যান্ডে সেই বাতাস বইতে শুরু করেছে। ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট আর ইস্টার্ন ফ্রন্ট সমানভাবে কন্ট্রোলে রাখতে পারবেনা ভারত। মাত্র বাইশ কিলোমিটার প্রশস্তের চিকেন নেইক বন্ধ করে দিতে পারে স্বাধীনতাকামীরা। বাংলাদেশ থেকে সারাজীবনের অবৈধ ট্রানজিট (করিডোর) জনগণ মেনে নেবেনা। কাশ্মিরকে রক্তাক্ত করে ভারত তার অখণ্ডতা কতদিন ধরে রাখতে পারবে সেটা নিয়েও বিশ্লেষকেরা নানান মন্তব্য করতে শুরু করে দিয়েছেন। প্রতিবেশীদের সাথে সংঘাত, নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন প্রতিষ্ঠা করে মোদি নিজে নব্য নাজি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, কাশ্মিরে সরকারি বাহিনী যেন জাপানি বাহিনীর মাঞ্চুরিয়া গণধর্ষণের রেকর্ড ভাঙতে পাঠানো হয়েছে। বিশাল ভারত রাষ্ট্রকে তিনি ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির ফ্যাসিজমের ইতালিতে রূপান্তরের পায়তারা করছেন।
কাশ্মিরকে পুলিশি স্টেট বানাতে চাচ্ছেন। নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব ইংল্যান্ড বিমান থেকে বোমা হামলা করতো ইরাক ও ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের সাধারণ নাগরিকদের উপর। বর্তমান ভারতের মধ্যে সেইসব উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।
জাতীয়তাবোধ আর চাপিয়ে দেয়া দাসত্ব যখন মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তখন জাতীয়তাবোধেরই বিজয় হয়। কাশ্মিরি জনগণ যে বোধ ধারণ করে প্রতি মুহুর্তে একটানা সংগ্রাম ও নির্যাতনের স্মৃতির শক্তি নিয়ে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তার বিজয় অনিবার্য, অবশ্যম্ভাবী।
জাতীয়তাবোধ আর চাপিয়ে দেয়া দাসত্ব যখন মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তখন জাতীয়তাবোধেরই বিজয় হয়। কাশ্মিরি জনগণ যে বোধ ধারণ করে প্রতি মুহুর্তে একটানা সংগ্রাম ও নির্যাতনের স্মৃতির শক্তি নিয়ে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তার বিজয় অনিবার্য, অবশ্যম্ভাবী।
কাশ্মির ইস্যুতে বাংলাদেশের নাগরিকদের অবস্থা অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মিশরীয়দের মত। সরকারিভাবে মিশর যুদ্ধে না জড়ালেও নাজিবাদের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধ চালিয়েছে মিশরীয়রা। মুক্তি আন্দোলনের চিন্তা মুক্তিকামীদের এতটা আচ্ছন্ন করে ফেলে যে প্রবল শক্তিও তাদের কাছে খড়কুটার মত উড়ে যায়। মুক্তি আন্দোলনের জয় পরাজয় কোন নিয়ম মেনে হয়না। সময়ের প্রয়োজনে ঘটে যায়।
তিনটি আলাদা রাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত কাশ্মিরের অমর্যাদার নতুন স্ট্যাটাস তাদের ক্ষুদ্র গণ্ডির বাইরে নিয়ে আসতে উদ্ভুদ্ধ করবে। ভবিষ্যতে ভারতকে কাশ্মিরি জনগণ আর বিশ্বাস করবেনা। আর অবিশ্বাসী নাগরিকদের জোর করে বা দেনদরবার করে দাবিয়ে রাখা যায়না। প্রবল জনমতকে উপেক্ষা করে দুনিয়ার কোন সিদ্ধান্তই আলোর দেখা পায়নি।
কাশ্মির বর্তমানে পৃথিবীর সর্বাধিক সামরিক অধ্যুষিত এলাকা। বিজেপি সরকারই শুধুমাত্র এখন ভারতের সর্বেসের্বা। এককভাবে সামরিক সিদ্ধান্তগ্রহণ ও প্রয়োগে পার্লামেন্টকে ব্যবহারের প্রয়োজন মনে করেনি তারা। গোপনে কাশ্মিরকে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং এখনো চলছে।
সীমিত আকারে সেখানে টেলিযোগাযোগ, স্কুল কলেজ খুললেও। ভয়ে কেউ বের হচ্ছেনা। সরকারি ল্যান্ড ফোনে সারাদিন লাইনে দাড়িয়ে থেকে সর্বোচ্চ একমিনিট কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে তারা। এটাকেই ভারতীয় মিডিয়া বৃটেনের লোকার্নো চুক্তির মত ঢাকডোল পিটিয়ে প্রচার করছে।
কাশ্মির পরিষ্কার একটি নতুন সংঘর্ষের দিকে যাচ্ছে। এই সংঘর্ষের একদিকে মোদির বিজেপি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা অপরদিকে কাশ্মির, ভারতের মানবতাবাদী জনতা, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মুজাহিদিন এবং সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ।
বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে আসাম নিয়ে যে পরিকল্পনা আছে তাতে আসামের শান্তিবাদী মানুষেরাও কাশ্মিরিদের পাশে দাড়াবে। অখণ্ড ভারতকে টুকরো টুকরো করতে উগ্র হিন্দুত্ববাদই যথেষ্ট।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন