পার্সিয়ান কবি শেখ সাদি বলেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে যখন মূর্খরা ‘উদ্ভট আদেশ’ জারি করে দেশ চালাবে। নির্বোধরা তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য গর্ব বোধ করবে। আর পন্ডিতরা তাদের পান্ডিত্যের জন্য অনুশোচনায় ভুগবে। শেখ সাদির বলে যাওয়া সেই কথাগুলোই এখন সত্যি হচ্ছে বোধয়। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোতে এমন কিছু মানুষ ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন, যারা সুস্থ মস্তিষ্কের কিনা তা নিয়েই সন্দেহ জাগে। ন্যায়পরায়ণ হয়ে দেশ পরিচালনা করা তো দূরের কথা, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে হাজারটা অন্যায়-অপরাধ। অথচ এই রাষ্ট্রনায়কেরাই বিপুল ব্যবধানে জিতে দেশের ক্ষমতায় বসেছেন। এদের মধ্যে অনেকে আছেন যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা শুনলে আক্ষরিক অর্থেই মূর্খ মনে হবে। আবার অনেকে আছেন যাদের নামের পাশে বেশ কয়েকটা বিশাল বিশাল ডিগ্রি, কিন্তু কাজ কারবার গণ্ডমূর্খের মতোই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, উল্টাপাল্টা আদেশ আর সিদ্ধান্তের জন্য মানুষের বাহবাও পাচ্ছেন তারা। এমন কিছু রাষ্ট্রনায়কদের নিয়েই এই প্রতিবেদন-
ডোনাল্ড ট্রাম্প
পৃথিবীর ইতিহাসে যত উদ্ভট রাষ্ট্রনায়ক এসেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে শুরুর দিকেই থাকবেন। একের পর এক উদ্ভট খবর তৈরি করেই যাচ্ছেন তিনি। কখনও নিজের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে টুইট করে বিদায় দিচ্ছেন, কখনও আবার দেশের নারী কংগ্রেসম্যানদের নিয়ে অশালীন কথা বলছেন। আর অনৈতিক সম্পর্কের কেচ্ছাকে তো তিনি ডালভাত বানিয়ে ফেলেছেন। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ট্রাম্প। অথচ শুদ্ধভাবে এক পৃষ্ঠা লিখতেও পারেন না তিনি। এছাড়া বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে ভুলভাল কথা বলাটাও এখন তার ‘ট্রেডমার্ক’ হয়ে গেছে। মুসলিম, অভিবাসী, আর আর প্রকৃতি এই তিনটিতে বোধয় ট্রাম্পের দারুণ অ্যালার্জি। ক্ষমতায় এসেই তিনি বেশ কয়েকটি দেশের মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশের ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ আরোপ করেছিলেন। অভিবাসী বিশেষ করে হিস্পানিক অভিবাসীরা তো তার দু’চোখের বিষ। কীভাবে তাদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া যায় তার ফন্দি ফিকির খুজতেই ব্যস্ত তিনি।
প্রকৃতি বা পরিবেশ নিয়েও ট্রাম্পের মনোভাব একই রকম। পুরো বিশ্বের গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীকে বাঁচাতে আমাদের প্রকৃতির প্রতি যত্নবান হতে হবে, কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ কমাতে হবে। অথচ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পরিবেশ বিষয়ক সমস্ত চুক্তি আর নীতিমালাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়েই চলেছেন।
উল্টাপাল্টা বকুনিতে যদি কোনো অ্যাওয়ার্ডের ব্যবস্থা থাকতো সেটা নিঃসন্দেহে ট্রাম্পই পেতেন। কিছুদিন আগেই তিনি বলেছিলেন, মানুষের কিডনি থাকে হার্টের ভেতর। নেপাল আর ভূটানকে ভারতের অংশ বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। এসব শুনে যে কারও মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, ট্রাম্প আসলেই কোনো পড়াশুনা করেছেন, নাকি তিনি নিতান্তই এক গণ্ডমূর্খ?
বরিস জনসন
বর্তমান সময়ে ট্রাম্পের প্রতিরূপ হিসেবে ভাবা হচ্ছে নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে। ট্রাম্প যেমন অনৈতিক সম্পর্কের কারণে সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন, ঠিক তেমনি জনসনও বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের কারণে আলোচনায় এসেছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও সস্তা কৌতুক করতে পছন্দ করেন জনসন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে থাকাকালীন তিনি যুক্তরাজ্যের জন্য বেশ কিছু লজ্জাজনক ঘটনার কারণ হয়েছিলেন। অভিবাসীদের দেশ থেকে হটাতে তিনি ভীষণ তৎপর। যুক্তরাজ্যকে যেকোনো মূল্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আলাদা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে আতংক তৈরি করে তিনি ব্রিটিশদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছেন। একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রধান কাজ হলো, দেশে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। অথচ বরিস সেটা না করে বিভেদ বাড়িয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
মুহাম্মদ বিন সালমান
সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় এসেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছিলেন। বেশ কয়েকজন সৌদি প্রিন্সকে আটক করিয়েছিলেন। তাদের সম্পত্তি জব্দ করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সৌদি সাংবাদিক খাসোগি হত্যার পর তার আসল চেহারা প্রকাশ পেতে থাকে। খাসোগি হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে উঠে আসে তার নাম। খাসোগি ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরাতে তিনি যা করছেন তা আরও অদ্ভুত। নতুন সৌদি গড়ার নামে নাইট ক্লাব, কনসার্টের অনুমতি দিচ্ছেন। অথচ মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথাই নেই।
জাইর বোলসোনারো
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো। ব্রাজিলীয় ট্রাম্প হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর জাইর বোলসোনারোকে মানিকজোড় বলা যেতে পারে। তাদের নীতি-কৌশল একই ধরণের। বোলসোনারোর পদক্ষেপের ফলে আমাজন উজার হচ্ছে। মূর্খের মতো মন্তব্য করার ক্ষেত্রেও ট্রাম আর তিনি সমানে সমান। কয়েকদিন আগে তিনি বলেছেন, মানুষ একদিন পরপর মলত্যাগ করলেই পরিবেশ রক্ষা পাবে। আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘নারী-পুরুষের সমান মজুরি পাওয়ার সুযোগ নেই, কারণ নারীরা গর্ভবতী হয়।’
নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি তার দেশে ব্যাপক জনপ্রিয় এটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু এই রাষ্ট্রনায়কের মাথায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ্যত্ব প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কিছু আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। একজন রাষ্ট্রনায়ক তার দেশকে এগিয়ে নিতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু মোদি যা করছেন তাকে পাগলামি বলছেন নিশ্লেষকরা। একজন রাষ্ট্রনায়ক সবাইকে নিয়ে ভাববে, দেশে শান্তি বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে, এমনটাই আশা করে সবাই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির ক্ষেত্রে এর উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে। দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমদের হটাতে তিনি একের পর পদক্ষেপ নিয়েই যাচ্ছেন। ফলে ভারতে ধর্ম-বর্ণের মাঝে বিভেদ বাড়ছে। এই পরস্থিতিকে অশনি সংকেত বলে অভিহিত করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মোদির পদক্ষেপ ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শ্রেষ্ঠ্যত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে, কিন্তু ভারতের চিরচেনা যে মানবিকতার নীতি সেটা একেবারেই ম্লান করে দেবে। শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নিজ দেশের জনগণকেও অবহেলা করছেন মোদি। তিনি অস্ত্র-শস্ত্র কিনতে এবং মহাকাশে যান পাঠাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছেন অথচ তার দেশেই লক্ষ লক্ষ শিশু অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। সেদিকে তিনি ফিরেও তাকাচ্ছেন না।
বিশ্ব রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বর্তমানে সারা বিশ্বেই উদ্ভট ও মূর্খ নেতারা দেশের শীর্ষ পদে উঠে আসছেন। এটা অবশ্যই ভয়ের কারণ। তবে এর থেকেও বেশি আতংকের কারণ হলো, নিজ দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের সমর্থন দিচ্ছে। এর অর্থ হলো, মানুষের মধ্যে থেকে মানবিকতাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে বিভেদ-বিদ্বেষ বাড়ছে। এই বিভেদ-বিদ্বেষ কখনোই মঙ্গলজনক হতে পারে না। এটা পুরো মানবজাতির জন্যই অশনি সংকেত।
বাংলা ইনসাইডার/
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন