মোঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় ১৫২৮-২৯ সালে গড়ে উঠেছিল মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় নির্দশন বাবরি মসজিদ। মীর বাকী নামের এক ব্যক্তির শিল্পকর্মে গড়ে উঠা এই মসজিদটির নামকরণও করা হয় সম্রাট বাবরের নামে। পরবর্তীতে ভারতের কট্টরপন্থি উগ্রবাদী হিন্দুদের একাংশ দাবি তোলে, যে জায়গাটিতে বাবরি মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছিল সেটি ছিল রাম অবতারের পবিত্র জন্মভূমি। সেখানে থাকা রাম মন্দির ভেঙে সম্রাট বাবর গড়ে তুলেছিলেন বাবরি মসজিদ। এ নিয়ে গত কয়েক শতক ধরে চলা বিতর্ক এক পর্যায়ে ভারতের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে।
১৮৮৫ সালে মসজিদ প্রাঙ্গণে হিন্দু ধর্মীয় সংস্থাগুলো দেবতা রামের সম্মানে একটি মন্দির নির্মাণের অনুমিত চাইলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ১৯৪৯ সালে একদল হিন্দু মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে রামের একটি মূর্তি স্থাপন করেন। কিন্তু সেটি না সরিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। এ ছাড়া একজন হিন্দু ধর্মীয় গুরুকে সেটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৮৬ সালে ফয়জাবাদ জেলা প্রশাসন মসজিদ প্রাঙ্গণ হিন্দুদের ধর্মীয় আচার পালনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এর পর ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পরিস্থিতি বেশ শান্তই ছিল।
কিন্তু ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর শিবসেনা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও ক্ষমতাসীন বিজেপির সমর্থনে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে দাঙ্গায় শুধু মুম্বাই ও দিল্লিতেই অন্তত ২ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। বলা হয়ে থাকে, ভারতের ইতিহাসে এত বড় অভ্যন্তরীণ দাঙ্গা আর কখনও হয়নি।
২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর দুই ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদের দেয়া সাক্ষাৎকারে বেরিয়ে আসে মূল সত্যটি। হাফিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ সুপ্রিয় ভার্মা ও জয়া মেনন দাবি করেন, বাবরি মসজিদের নিচে রামমন্দিরের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। এ নিয়ে হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা ছড়াতে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর (এএসআই) মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল বলেও দাবি করেন এ দুই প্রত্নতত্ত্ববিদ।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে তারা বলেন, সেখানে রামমন্দির থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
অথচ ২০০৩ সালে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বাবরি মসজিদের নিচে খননকাজ চালিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টকে জানায়, ওই মসজিদের নিচে তিনটি রামমন্দিরের অস্তিত্ব পেয়েছেন তারা। এর পরই তাৎক্ষণিকভাবে কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদীরা আরও সরব হয়ে উঠে। কিন্তু এএসআই-এর দেয়া তথ্য যে ভুল ছিল সেটিই দেখিয়েছেন ভারতেরই দুই প্রত্নতত্ত্ববিদ।
জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুপ্রিয় ভার্মা ও নাদার ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের প্রধান মেনন শিব সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের পক্ষে পরবর্তীতে ওই বাবরি মসজিদের নিচে খননকাজ চালিয়ে ২০১০ সালে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে এক নিবন্ধে তাদের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন।
ওই পর্যবেক্ষণ প্রকাশের আরও প্রায় ৮ বছর গত ২০১৮ সালে হাফিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সুপ্রিয় ভার্মা বলেন, বিজেপির সরকার ভারতের ক্ষমতায় থাকায় খননকাজ চালাতে আমাদের চাপে পড়তে হয়েছিল। এর যথাযথ পর্যবেক্ষণ হোক সেটি কখনোই চাইতো না বিজেপি ও কট্টরপন্থিরা। বাবরি মসজিদের নিচে রামমন্দিরের অস্তিত্ব আছে এমনটি বলতে আমাদের বাধ্য করা হচ্ছিল।
ওই সাক্ষাৎকারে সুপ্রিয় ভার্মা আরও দাবি করেন, বাবরি মসজিদের নিচে মন্দির নয়, পুরোনো ছোট মসজিদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর পশ্চিম পাশের দেয়াল, ৫০টি পিলার ও স্থাপত্যশৈলীগুলোই এর বড় প্রমাণ। পশ্চিম পাশের দেয়াল দেখলে যে কেউই বুঝবে যে এখানে নামাজ পড়া হতো। ভেতরের কাঠামোও মন্দিরের মতো নয়, ছিল মসজিদের মতো।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন