মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে হামলার যে নির্দেশ শেষ মুহূর্তে স্থগিত করছিলেন, তাতে কোথায় কোথায় আঘাত হানার পরিকল্পনা ছিল? ঠিক কী কারণে তা স্থগিত হলো? ইরান কি পাল্টা আঘাত করতে পারত? পারলে সেই আঘাত কোথায় হানা হতো? সংবাদমাধ্যম বিবিসির বিশ্লেষক জোনাথন মার্কাস আড়ালে থাকা সেসব তথ্য তুলে ধরেছেন।
খবর পাওয়া যাচ্ছে, ট্রাম্প নাকি নিজেই আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে ইরানকে একটি বার্তা দিয়েছেন। ওমানের মাধ্যমে সেই বার্তা তেহরানের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে কী হতো?
ধরা যাক, ট্রাম্প শেষ মুহূর্তে মত পরিবর্তন করলেন না। তাহলে মার্কিন বাহিনীর আঘাত খুব সম্ভব হতো সীমিত। হয়তো আক্রমণ চালানো হতো ইরানের কিছু রাডার বা ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনার ওপর এবং তার সঙ্গে যোগ হতো কিছু কূটনৈতিক সতর্কবাণী। তবে এটা ভোলা যাবে না যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শনিবার এ কথাও বলেছেন যে ‘ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনা এখনো আছে।’
ইরানি শাসক গোষ্ঠীকে উত্খাত করতে অবশ্য পূর্ণমাত্রার মার্কিন স্থল অভিযান ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই, যদিও হোয়াইট হাউসের কোনো কোনো লোক তেমন কিছু একটা চায়। এর কারণ সামরিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে ইরান অনেক বেশি জটিল এক চ্যালেঞ্জ। তারা সাদ্দাম হোসেনের ইরাক নয়।
ইরানের পাল্টা আঘাত
এরপর ইরান নিশ্চয়ই পাল্টা আঘাত হানত—হয়তো কোনো মার্কিন জাহাজ বা বিমান আক্রান্ত হতো। এ ছাড়া ইরান উপসাগরে জাহাজ বা তেলবাহী ট্যাংকারের চলাচল বিঘ্নিত করতে মাইন, ছোট আকারের নৌকা, বা সাবমেরিন দিয়ে আক্রমণ চালাত। মনে রাখতে হবে, আমেরিকানদের যে ড্রোন ইরান ভূপাতিত করেছে, তা অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য আহরণের যত উন্নত ব্যবস্থাই থাকুক না কেন, তাদের দুর্বলতাও আছে। ইরান হয়তো ভাবছে, তারা যদি কয়েকটা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারে তাহলে ট্রাম্প হয়তো ভাববেন, এত চড়া মূল্যে যুদ্ধ চালানোর দরকার নেই।
যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা আঘাত হানলে কী হবে?
মনে রাখতে হবে, এ যুদ্ধ হবে অসম। অর্থাৎ একটি পক্ষ খুবই শক্তিশালী, অন্য পক্ষ অপেক্ষাকৃত দুর্বল। ইরানের হামলার জবাবে আমেরিকানরা ইরানি নৌ স্থাপনা, বিমানঘাঁটির ওপর আঘাত হানতে পারে বিমান বা ক্রুজ মিসাইল দিয়ে। তারা হয়তো ইরানের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করতে পারে, ইরানি সামরিক বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারে। কিন্তু ইরান যা করতে পারে তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের এমন কিছু ক্ষতিসাধন করা, যা যুক্তরাষ্ট্রে জনমতকে এ যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দেওয়া।
সংঘাত যদি পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়?
চাপের মুখে পড়লে ইরান এই সংঘাতকে ছড়িয়ে দিতে পারে। তার প্রক্সি দেশ যেমন ইরাক, সিরিয়া বা অন্যদের আহ্বান জানাতে পারে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানতে। এমনকি এটাও হতে পারে যে হিজবুল্লাহ বা সিরিয়ায় থাকার ইরানি সৈন্যদের সমন্বয়ে ইসরায়েলের ওপর রকেট হামলা হতে পারে। এর লক্ষ্য হবে, ওয়াশিংটনকে এটা দেখানো যে ইরানের ওপর কোনো ছোট আকারের আঘাতও পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে দিতে পারে।
আফগানিস্তান এবং ইরাকের অভিজ্ঞতা থেকে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এটা বুঝেছে যে আধুনিক যুগে কোনো যুদ্ধে প্রচলিত অর্থে ‘জয়ী’ হওয়া যায় না। ইরানও নিশ্চয়ই মনে করে না যে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে ‘হারাতে’ পারবে।
প্রকৃতপক্ষে দুই পক্ষই চায় ‘কৌশলগত’ বিজয়। যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরানকে ‘কনটেইন’ করতে, অর্থাৎ সে যেন একটা সীমার বেশি বাড়তে না পারে। তার সামরিক ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে হয়তো সে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। যদিও এতে আবার বিপরীত ফলও হতে পারে, ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর প্রতি জনসমর্থন বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে ইরানও হয়তো চাইছে, একটা সামরিক সংকট তৈরি করে ট্রাম্প প্রশাসনকে বিপাকে ফেলতে, যাতে আমেরিকার আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা কমিয়ে দেওয়া যায়। ফলে আগামীতে ডেমোক্রেটিকরা ক্ষমতায় এলে তারা হয়তো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে পারে, নতুন একটি পরমাণু চুক্তিও হতে পারে।
তবে ইরানের সমস্যা হলো তাদের হাতে সময় বেশি নেই। ট্রাম্পের হয়তো সে সমস্যা নেই। কিন্তু ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ হলে তা হবে ব্যয়বহুল, আর এর ফল কী হবে, তা আগে থেকে বলাও কঠিন। হয়তো এতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিও বন্ধ হবে না, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবও কমবে না। এক হিসাবে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে উত্খাত করার ফল হয়েছে এটাই যে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বেড়ে গেছে। সব সংঘাতেরই এমন কিছু পরিণতি হয়, যা আগেকার হিসাব-নিকাশে বোঝা যায়নি।
সূত্র : বিবিসি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন