মুসলিম ম্যাটার অবলম্বনে, মুহাম্মদ আল-বাহলুল
২০১১ সালে সমগ্র আরববিশ্বে স্বৈরশাসন উৎখাতের ডাক দিয়ে সূচনা হয় সর্বগ্রাসী এক বিপ্লবের। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে পরিচিত সর্বগ্রাসী এই বিপ্লবে নড়ে উঠে আরব বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন সময় ক্ষমতা কুক্ষিগতকারী শাসকদের গদি। শ্রেনী-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সাধারন আরব জনগনের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই বিক্ষোভসমূহে পতন ঘটে তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন সহ কিছু রাষ্ট্রের স্বৈরশাসকদের।
ত্রিশ বছর ক্ষমতাসীন মিসরীয় স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের গদির পতন ঘটে মিসরীয় জনগনের অংশগ্রহণের এই বিপ্লবে। ইতিহাসে প্রথমবারের মত মিসরীয় জনগণ তাদের নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে শাসক নির্বাচনের সূযোগ লাভ করে।
২০১২ সালে বিপ্লবের এক বছর পর মিসরীয় জনগণ এক সাধারন নির্বাচনে প্রথমবারের মত তাদের প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করে। গণতান্ত্রিকভাবে মিসরের সাধারন জনগণের ভোটে প্রথমবারের মত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন মুহাম্মদ মুরসী।
যদিও ষড়যন্ত্রমূলক সেনা অভ্যুত্থানে এক বছরের মাথায় তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং মিসর আবার স্বৈরশাসনের খপ্পরে পড়ে, তথাপি মিসরের ইতিহাসে জনগণের নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনিই স্বীকৃতি লাভ করেন।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপরই সামরিক জান্তার কারাগারে বন্দী হন মুহাম্মদ মুরসী। সন্ত্রাসবাদে মদদদান, রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচার ও আদালত অবমাননা সহ মোট ছয়টি অভিযোগ তার বিরুদ্ধে গঠন করা হয়।
গত ১৭ই জুন, আদালতে এরূপ এক অভিযোগে তার বিচার চলাকালে তিনি অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।
এখানে মুহাম্মদ মুরসীর জীবনের বিভিন্ন অজানা ও কম পরিচিত তথ্য থেকে দশ তথ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
১. কুরআনের হাফেজ
মুহাম্মদ মুরসীর অসংখ্য অজানা তথ্যের মধ্যে অন্যতম হল, তিনি কুরআনের হাফেজ ছিলেন। তিনি পৃথিবীর বিরলতম একজন রাষ্ট্রনায়ক, যিনি তার হৃদয়ে কুরআনকে ধারণ করেছিলেন।
২. বিদ্যা ও পান্ডিত্য
মুহাম্মদ মুরসীর পান্ডিত্যও বিশ্ব গণমাধ্যমে কম আলোচিত একটি বিষয়। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন মিসরের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। এছাড়া তিনি বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি নাসার বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে মিসরে ফিরে আসেন।
৩. নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস
কায়রো শহরের বিভিন্ন স্থানে মিসরের প্রেসিডেন্টের জন্য বিলাসবহুল প্রাসাদ ছিল। কিন্তু মুহাম্মদ মুরসী যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, তিনি সিদ্ধান্ত নেন এর একটিতেও বাস না করার। তিনি বরং কায়রোতে এক ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করতে থাকেন।
পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানরা যেখানে তাদের জন্য নির্ধারিত বিশেষ বাসভবনে তাদের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে অবস্থান করেন, সেখানে তিনি এরূপ কোন সুবিধা গ্রহণ না করেই তার ভাড়া করা নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে সপরিবারে বসবাস করতেন।
৪. অসুস্থ বোনের চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় বিশেষ ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান
মুহাম্মদ মুরসী প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে তার বোন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে বোনকে দেখতে গেলে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে জানায়, ইউরোপ বা আমেরিকায় তার বোনের উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ সম্ভব। শুধু তার আদেশেই রাষ্ট্রীয় হেলিকপ্টার বা বিমানে তাকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় চিকিৎসার জন্য নেওয়া যেত। কিন্তু সাধারন মিসরীয়দের উপর তার পরিবার বিশেষ কোন সুবিধা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতির কারনে তার বোনকে বাইরে চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠানো হয়নি। পরবর্তীতে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় তার বোন ইন্তেকাল করেন।
৫. আজানে বক্তব্যে বিরতি
একবার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসীর বক্তব্য করার মাঝে নামাজের সময় হলে আজান শোনা গেলে তিনি তার বক্তব্য থামিয়ে দেন। বক্তব্য থামিয়ে শুধু চুপ করে না থেকে তিনিও সাথে সাথে আজান দেওয়া শুরু করেন। সাধারন ধার্মিক মিসরবাসীর জন্য এ ছিল গৌরবের, যে তাদের নেতারা আল্লাহর আহবানের কাছে আত্মসমর্পন করেছে।
৬. গৃহহীন বিধবা
কায়রোর রাস্তায় এক গৃহহীন বিধবা বসবাস করতেন। একবার রাস্তায় যাওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট মুরসী তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন কেন তিনি রাস্তায় বসবাস করছেন। বিধবা জানান, স্বামীকে হারানোর পর থেকে তিনি অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া দান করতে না পারার কারনে রাস্তায় বসবাস করতে বাধ্য হয়েছেন।
মুহাম্মদ মুরসী তাকে বলেন, মিসরের কোন মা এভাবে কষ্ট করতে পারেনা। তিনি তখন তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন বিধবার জন্য যথাযথ এক অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করা এবং তার জীবন নির্বাহের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করার জন্য।
কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের পর এই বিধবা আবার গৃহহীন হয়ে পড়েন।
৭. সাধারন মানুষের পক্ষ গ্রহণ
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পূর্বেও মুহাম্মদ মুরসী নিজেকে সাধারন মানুষের সাহায্যে উৎসর্গ করেন। শুধু তার দেশ মিসরই নয়, বরং অন্যান্য দেশেও তিনি তার এই ভূমিকাকে সম্প্রসারিত করেন।
২০০৭ সালে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় ভয়াবহ সুনামীর পর তিনি এই অঞ্চলে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আগমন করেন। এছাড়া তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদ তাকে অভিবাদন জানালে তিনি উত্তর দেন,
“আমি আপনাকে সিরিয়ার জনগনের নায্য প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করি না।”
৮. বিশ্বের স্বল্পতম পারিশ্রমিক প্রাপ্ত রাষ্ট্রনায়ক
সাধারন স্বল্পতম ক্ষমতার অধিকারী হলেই অনেক দেশে আমরা ক্ষমতাশালীদের নিজেদের জন্য বিপুল অর্থের পাহাড় গড়ে তুলতে দেখি। কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসী কায়রোতে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। বছরে মাত্র দশ হাজার ডলার তিনি তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পারিশ্রমিক হিসেবে নির্ধারন করেছিলেন। যখন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, তখন দেখা যায় যে তিনি তার পুরো সময়ে কোন প্রকার বেতন উত্তোলন করেননি। অর্থাৎ পুরোটা সময় তিনি বিনা বেতনে কাজ চালিয়েছিলেন।
৯. নামাজে ইমামতি
মুহাম্মদ মুরসী শুধু জামায়াতে নামাজ আদায়ই নয়, তিনি ছিলেন নামাজের জামায়াতেরও ইমাম। নামাজের জামায়াত তার ছুটে যাওয়াতো দূরের কথা, অনেক সময় তিনি মসজিদে নামাজের ইমামতিরও দায়িত্ব পালন করতেন।
১০. রাষ্ট্রীয় ভবনে ছবি সংরক্ষণে নিষেধ
সকল আরব স্বৈরশাসকদের অনুশীলন ছিল রাষ্ট্রীয় সকল অফিসে তাদের ছবির সংরক্ষণ করা। প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের সময় মিসরের যেকোন জায়গায়ই যাওয়া হোকনা কেন, তার ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল।
কিন্তু মুহাম্মদ মুরসী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর এই অনুশীলনের ব্যতিক্রম করেন। তিনি তার ছবির পরিবর্তে মিসরের সকল অফিসে আল্লাহর নামকে স্থলাভিসিক্ত করেন।
হয়তো তার শাসনামলে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করেছিলেন, যা তিনিও স্বীকার করেছেন; তথাপি তিনি স্পষ্টভাবেই ছিলেন আরবের সাধারন স্বৈরাচারী শাসকদের থেকে ব্যতিক্রমী শাসক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন