“আমরা অনিশ্চিত বিপদাপন্ন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এই নির্বোধের আক্রমণের যুগে, ফেসবুকের ‘লাইকের’ যুগে, ফ্যাসিবাদের আন্দোলনের যুগে, ফেইক নিউজের যুগে এবং একটি জাতি যেখানে বিলুপ্তির পথে— সেখানে সাহিত্যের প্রকৃত অবস্থা কি?” প্রশ্ন রেখেছেন রায়।
ফ্যাসিবাদ, মোদি এবং আজকের বিশ্বে একজন লেখকের অবস্থান সম্পর্কে অরুন্ধতী রায় পেন আমেরিকায় সম্প্রতি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা গত ১৩ মে ২০১৯ দি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে জবান’র পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন উম্মে সালমা।
এই বছরের আর্থার মিলার ‘ফ্রিডম টু রাইট’ লেকচার অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করার জন্য PEN America কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে আমি সত্যি সম্মানিত বোধ করছি। যদি আর্থার মিলার এবং আমি একই প্রজন্মের হতাম এবং আমি যদি মার্কিন নাগরিক হতাম, আমার সন্দেহ হয় আমেরিকান বিরোধী কার্যকলাপ কমিটিতে মুখোমুখি হলে আমরা বিবাদে জড়িয়ে যেতাম। ভারতে, আমার পরিচয়পত্র ত্রুটিপূর্ণ। জাতীয়তা-বিরোধীদের (anti-nationals)— তালিকায় আমার নাম উপরের দিকে এবং আমার নাম ‘A’ দিয়ে শুরু হওয়ার কারণেই কিন্তু এটি ঘটেনি। দিনে দিনে এই তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। অবশ্য এটি একটি ভালো সুযোগ হতে পারে যে শীঘ্রই এটি স্বদেশপ্রেমীদের তালিকাকেও অতিক্রম করবে।
সম্প্রতি, একটি মানদণ্ডে কাউকে জাতি-বিরোধী বিচার করা যেন খুবই সহজ। যেমন আপনি যদি নরেন্দ্র মোদিকে ভোট না দেন তবে আপনি একজন পাকিস্তানি। আমি জানি না পাকিস্তান সরকার তার এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে ঘিরে কেমন অনুভব করছে?
সম্প্রতি, একটি মানদণ্ডে কাউকে জাতি-বিরোধী বিচার করা যেন খুবই সহজ। যেমন আপনি যদি নরেন্দ্র মোদিকে ভোট না দেন তবে আপনি একজন পাকিস্তানি। আমি জানি না পাকিস্তান সরকার তার এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে ঘিরে কেমন অনুভব করছে?
অতি নিরানন্দের সাথে বলতে হয়, আমি এই সময় কাউকে ভোট দিতে পারব না। কারণ আজকে, ১২ই মে, আমার শহর দিল্লিতে ভোটগ্রহণ চলছে। আমার বন্ধুগণ এবং সহকর্মীবৃন্দ (কারাগারের বাইরে যারা আছেন) ইলেকশন বুথের বাহিরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন এবং মনে-প্রাণে আশা করেন যে তুরস্ক এবং ব্রাজিলের ভাগ্যে যা ঘটে তা আমাদের ভাগ্যে ঘটবে না। আর ঘটবে বলেও আমি বিশ্বাস করি না। রেকর্ড অনুযায়ী, ভারতের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পূর্বেই আমি এখানে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। সুতরাং মিস্টার মোদি যদি একজনের ভোটেও জয়লাভ করে, তবে মনে রাখতে হবে আপনাদের সকলকেই এর দায়ভার বহন করতে হবে।
যাই হোক, আমরা এখন এ্যাপোলো থিয়েটারের লিজেন্ডারি হারলেমে অবস্থান করছি। যার দেয়ালগুলো শুনছে এবং সম্ভবত গোপনে সংরক্ষণ করছে, হৃদস্পন্দন সংগীত বেজে চলছে। যখন কোনো শ্রোতা থাকে না তারা সম্ভবত নিজেরাই গুনগুন করে।
এ দেয়ালগুলো হয়তো আরেথা ফ্রাঙ্কলিন, জেমস ব্রাউন, স্টিভ ওন্ডার, অথবা লিটল রিচার্ডের মিউজিক নিয়ে আলোচনা করে। এর থেকে উত্তম ভেন্যু আর কি হতে পারে যেখানে সাহিত্যের নিমিত্তে সমস্ত ইতিহাস নিয়ে এক জায়গায় চিন্তাভাবনা করা যায়। এই সময় এই মুহূর্তে, যখন আমরা একটা যুগ নিয়ে আলোচনা করি— সঠিকভাবে না হোক, একটা ইঙ্গিত দেয়া যায়, এই যুগ প্রায় শেষের দিকে।
যেখানে বরফের ছাঁচগুলো গলে যাচ্ছে, সমুদ্র উত্তপ্ত হচ্ছে এবং ভুজলতল নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সূক্ষ্ম জালের অভ্যন্তরে বসবাস করছি। এই গ্রহে আমরা দুর্দান্ত বুদ্ধিমত্তা দ্বারা মানবজাতি এবং মেশিনের মধ্যকার সীমানা লঙ্ঘন করে চলছি। এবং এমন কি আমাদের প্রচণ্ড ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এই গ্রহে একটি প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকার সামর্থ্যকেও গোপনে ধ্বংস করছে। আমরা শিল্পকে গাণিতিক পরিভাষায় স্থানান্তর করেছি এবং একটি ভবিষ্যতের সূচনা করেছি যেখানে অধিকাংশ মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হবার কোনো প্রয়োজন নেই। ঠিক এটি এমন এক সময় যেখানে হোয়াইট হাউসের আধিপত্যবাদী, চীনের নব্য-সাম্রাজ্যবাদী, ইউরোপের রাস্তায় নব্য নাৎসিবাদী, ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং ভয়ানক খুনীদের গডফাদার এবং অন্যান্য দেশের নিকৃষ্টতর স্বৈরশাসকদের কঠোর ছত্রচ্ছায়ায় আমরা ধাবিত হচ্ছি এক অজানার দিকে।
ঠিক এটি এমন এক সময় যেখানে হোয়াইট হাউসের আধিপত্যবাদী, চীনের নব্য-সাম্রাজ্যবাদী, ইউরোপের রাস্তায় নব্য নাৎসিবাদী, ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং ভয়ানক খুনীদের গডফাদার এবং অন্যান্য দেশের নিকৃষ্টতর স্বৈরশাসকদের কঠোর ছত্রচ্ছায়ায় আমরা ধাবিত হচ্ছি এক অজানার দিকে।
যখন আমাদের অনেকেই স্বপ্ন দেখতো, “আরেকটি বিশ্বের উত্থান সম্ভব”; এই স্বপ্ন তখন জনসাধারণেরও ছিল। এবং বর্তমানে এটি তাদের স্বপ্ন
-আর আমাদের জন্য দুঃস্বপ্ন
– এই ভয়ংকর সত্য উপলব্ধি করার সময় চলে এসেছে।
পুঁজিবাদের ভিত্তিহীন যুদ্ধ এবং সীমাহীন লোভ বিপন্ন করে দিয়েছে এই গ্রহকে এবং এর ফলে শরণার্থীদের দ্বারা ভরে গেছে এই পৃথিবী। এর বেশিরভাগ দায় গিয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ওপর। সতেরো বছর ধরে আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণের একমাত্র লক্ষ্য ছিল তালিবানদের ধ্বংস করা, অথচ আমেরিকান সরকার আবার সেই তালিবানদের সাথেই বৈঠকে বসেছে। এই মধ্যবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার মতো দেশগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। হাজার হাজার শত শত মানুষ তাদের জীবন হারিয়েছে এই যুদ্ধে। গোটা একটা এলাকায় দেখা দিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা। প্রাচীন শহরগুলো ধুলোয় মিলিয়ে গেছে। এই সকল জনশূন্য আর ধ্বংসাবশেষ শহরে উত্থান ঘটেছে আইএস (ISIS) নামক এক ভয়ংকর জন্তুর। এরা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বে, নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করছে যারা আমেরিকান যুদ্ধের সাথে কোনোভাবেই জড়িত নয়। বিগত বছরগুলোতে, আমেরিকান সরকার ইচ্ছেমতো আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহের বরখেলাপ করেছে এবং নিজেদের মতো করে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের সংজ্ঞা প্রদান করেছে। এবং বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্রকে কেন্দ্র করে সেই একই পুরানো ভীতিসঞ্চালক কৌশল, একই বিষাদে ভরা মিথ্যাচার, এবং সেই পুরানো ফেইক নিউজকে অবলম্বন করে ইরানে বোমা ফেলার প্রস্তুতি চলছে। আর এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সবচেয়ে বড় ভুল।
সুতরাং বলা যায়, আমরা অনিশ্চিত বিপদাপন্ন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এই নির্বোধের আক্রমণের যুগে, ফেসবুকের ‘লাইকের’ যুগে, ফ্যাসিবাদের আন্দোলনের যুগে, ফেইক নিউজের যুগে এবং একটি জাতি যেখানে বিলুপ্তির পথে -সেখানে সাহিত্যের প্রকৃত অবস্থা কি?
কি দিয়ে সাহিত্যকে বিচার করা যায়? কে এই সিদ্ধান্ত দিবে? অবশ্যই এই সকল প্রশ্নের কোনো একক, যথার্থ উত্তর নেই। আপনারা যদি আমাকে অনুগ্রহপূর্বক ক্ষমা করেন, তবে আমি আমার লেখক জীবনের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলব। সেই সাথে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই যে প্রশ্নবানে আমি সবচেয়ে বেশি জর্জরিত -এই সময়ে, বিশেষ করে, হাজার শতাব্দী ধরে স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে টিকে থাকা ভারতের মতো একটি দেশে কিভাবে একজন লেখক হওয়া যায়।
কয়েক বছর আগে, আমি একটি রেইলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম এবং পত্রিকা পড়ছিলাম। ভেতরের পৃষ্ঠায়, একটি ছোট সংবাদ প্রতিবেদন আমার নজরে পড়ে। যেখানে উল্লেখ ছিল, ভারতীয় গুপ্ত, নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী) বাহক হিসেবে অভিযুক্ত করে দুইজন লোককে আটক করা হয়েছে। সেই রিপোর্ট হতে জানা যায়, সেই অভিযুক্ত লোকগুলোর কাছ থেকে কিছু ‘আইটেম’ উদ্ধার করা হয় যার বেশিরভাগই ছিল ‘অরুন্ধতী রায়ের বই’। এর পর খুব বেশি দেরি না করে, আমি কলেজের একজন শিক্ষিকার সাথে দেখা করি যিনি তার বেশিরভাগ সময়ই ব্যয় করেন ‘অ্যান্টিন্যাশনাল এক্টিভিটিস’ মামলায় জড়িতদের আইনগত সুরক্ষা দিতে। আর এদের বেশিরভাগই তরুণ ছাত্রছাত্রী এবং গ্রামবাসী যারা কর্পোরেট খনন এবং কাঠামো প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। কেননা এসকল প্রকল্পের কারনে হাজার হাজার গ্রামবাসী তাদের জমি এবং বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়েছে। তিনি আমাকে জানান, অসংখ্য জেলবন্দীদের কাছ থেকে একরকম বলপূর্বক ‘স্বীকারোক্তি’ নেয়া হয়েছে -আমার লেখনী তাদের আন্দোলনে প্রলুব্ধ হতে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে যাকে পুলিশ ‘ভুল পথ’ বলে আখ্যায়িত করেন।
সেই কলেজ শিক্ষিকা আমাকে আরও অবহিত করেন, তারা (পুলিশ) আমার বিপক্ষে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যে বইগুলোকে কেন্দ্র করে অভিযোগ তোলা হয়েছিল সেগুলো আমার কোনো উপন্যাস ছিল না (যদিও আমি কেবল একটি মাত্র উপন্যাস লিখেছিলাম- দ্য গড অব স্মল থিংস)
এই বইগুলো মূলত নন-ফিকশনের। যদিও এক পর্যায়ে এগুলোকে গল্প বলা যায়, বিভিন্ন ধরনের গল্প, তারপরেও কখনোই শুধুমাত্র গল্প বলা যায় না। এই গল্পগুলো বন, নদী, শস্য, বীজ, ভূমি, কৃষকশ্রেণি, শ্রম আইন,নীতি নির্ধারণ এর উপর কর্পোরেট আক্রমণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এবং হ্যাঁ, আমার গল্পগুলো ছিল ৯/১১ এর পরবর্তী ঘটনা এবং ন্যাটো কর্তৃক দেশের পর দেশ আক্রমণের কাহিনির ওপর। আর বেশিরভাগ গল্পই রচিত হয়েছে সাধারণ জনগণকে কেন্দ্র করে যারা এসকল আক্রমণের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছে সংগ্রাম করেছে। সুনির্দিষ্ট গল্পগুলো সুনির্দিষ্ট নদী, সুনির্দিষ্ট পর্বতসমূহ, সুনির্দিষ্ট কর্পোরেট সংগঠনসমূহ সুনির্দিষ্ট আন্দোলনের উপর গড়ে উঠেছে। এলাকার লোকজনই প্রকৃত জলবায়ু যোদ্ধা যারা এই সংকট, সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পূর্বেই অনুধাবন করতে পেরেছিল। এবং এখনও, এদেরকেই বিরামহীনভাবে অগ্রগতি এবং উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা এবং স্বদেশ-বিরোধী খলনায়ক হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার বনগুলোতে কর্পোরেট খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আদিবাসী লোকজনই যাদেরকে গেরিলা বলে অভিহিত করেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী যিনি মুক্ত বাণিজ্যের প্রচারক ছিলেন। এরা ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ নামে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এই বন বনানী সেনাবাহিনীদের দ্বারা ছেয়ে থাকতো সবসময়ই আর এইসকল সেনাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল এই গরীব আদিবাসী মানুষগুলো। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, লাতিন আমেরিকা -সর্বত্রই একই দৃশ্য, কোথাও কোনো পার্থক্য নেই।
এবং এখন, এইসব উপহাসগুলোর অন্যতম উপহাস হলো, একটি ঐক্যমত গড়ে উঠেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের মানেই হলো পৃথিবীর একক বৃহত্তম নিরাপত্তাবিষয়ক চ্যালেঞ্জ। ক্রমবর্ধমানহারে, এই অভিধানে সামরিকায়ন শব্দটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এবং কোনো সন্দেহ নেই এই জলবায়ু পরিবর্তনের ভুক্তভোগীরা ‘শত্রু’ হিসেবে পরিগণিত হবে নতুন এক যুদ্ধে, যে যুদ্ধ কখনোই শেষ হবে না।
জলবায়ু মোকাবিলায় ‘ইমার্জেন্সি’ বৈঠক আহবান করা যদিও ভালো অর্থবহন করে এবং প্রক্রিয়াও ত্বরান্বিত করে যা ইতিমধ্যে আরম্ভ হয়েছে। ইউএনএফসিসি (ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ) থেকে বিতর্কের বিষয়টি ইউনাইটেড নেশনস সিকিউরিটি কাউন্সিলে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে চাপ প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। অন্যভাষায় বলা যায়, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এবং স্থান বাদ দিয়ে বিষয়টিকে গোপনে নিয়ে আসা সেই একই পুরানো রহস্যময় ব্যাপার। শুধু তাই নয়, গ্লোবাল নর্থের বাসিন্দারা, যারা এই সমস্যার স্রষ্টা তারা পর্যবেক্ষণ করল যে, সমাধান তারা দিবে সেখান থেকে তাদের মুনাফা লাভ হবে। এ ধরনের সমাধান, কোনো সন্দেহ নেই, ‘ব্যবসা’এর মূল হাতিয়ার। এবং এর ফলে গুটিকয়েক লোকজনই অধিক বেচা-কেনা, অধিক ভোগ, এবং অধিক মুনাফা লাভের সাথে সরাসরি জড়িত। এক কথায়, পুঁজিবাদের আধিক্য।
যখন আমার রচনাগুলো প্রথম প্রকাশিত হয় (প্রথমে গণসংকলন ম্যাগাজিনে, তারপর ইন্টারনেটে এবং অবশেষে বই হিসেবে), ধ্বংসাত্মক এবং সন্দেহভাজনের দৃষ্টিতে দেখা হয় আমার কাজকে। কিছু ত্রৈমাসিক যারা পড়তেন তারা রাজনীতির সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোনো প্রয়োজন অনুভব করতেন না। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী, কোনো লেখাকে সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করা হয়। এই বিধ্বংসাত্বক লেখাগুলো ছিল বোধগম্যমূলক প্রতিক্রিয়া, যা বিশেষ করে একটি শ্রেণির মধ্যে প্রবলভাবে তৈরি হয়। কেননা তারা বুঝতে পারতো না আসলে এই লেখাগুলো কি— পুস্তিকা বা বিতর্কমূলক, পাঠ্যবই বিষয়ক অথবা সংবাদভিত্তিক লেখালিখি, ভ্রমণকাহিনি অথবা শুধু সাধারণ সাহিত্য নির্ভর অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি? কারো কারো কাছে, এগুলো লেখা হিসেবেও গণ্য হতো না। তারা বলতো: “ওহ, কেন আপনি লেখালিখি বন্ধ করলেন? আমরা আপনার পরবর্তী বইয়ের জন্য অপেক্ষা করছি।”
আমাকে কঠোরভাবে শিখানো হয় (বেশিরভাগই উচ্চ শ্রেণির মানুষগুলো কর্তৃক) কিভাবে লিখতে হবে, কোন কোন বিষয় নিয়ে আমার লিখালিখি করা উচিত, এবং কি রকম স্বরে আমার কথা বলা উচিত।
অনেকে এটাও ধারণা করতো যে আমি শুধুমাত্র ভাড়ায় লিখি। সব রকমের প্রস্তাবই আমার কাছে আসতো। যেমন: “প্রিয়, বাধের উপর আপনার লেখাটি আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে ; আপনি কি আমার জন্য চাইল্ড অ্যাবিউজের (শিশু যৌন নির্যাতন) উপর একটা প্রবন্ধ লিখে দিতে পারবেন? (এটি আসলেই ঘটেছিল)। আমাকে কঠোরভাবে শিখানো হয় (বেশিরভাগই উচ্চ শ্রেণির মানুষগুলো কর্তৃক) কিভাবে লিখতে হবে, কোন কোন বিষয় নিয়ে আমার লিখালিখি করা উচিত, এবং কি রকম স্বরে আমার কথা বলা উচিত।
তবে অন্যান্য জায়গায়, ভারতের অন্যান্য ভাষায় আমার রচনাগুলো দ্রুত অনূদিত হয়। এই রচনাগুলো পুস্তিকা হিসেবে বন এবং নদী, উপত্যকা, গ্রামাঞ্চলের যেসব এলাকাগুলো আক্রমণের শিকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে যারা প্রচণ্ড হতাশ তাদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল।
কেননা এই পাঠককুল রণাঙ্গনের সম্মুখভাগে অবস্থান করে, এরা অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয় এবং সাহিত্য কি অথবা সাহিত্যের ধরণ কি হওয়া উচিত এইসব নিয়ে— সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা এদের আছে।
আমি এটি উল্লেখ করেছি কেননা এটি আমাকে শিক্ষা দিয়েছিল যে লেখক এবং পাঠক ‘শ্রেণি’টাই সাহিত্যের জন্য স্থান নির্বাচন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি ভঙ্গুরও হয়ে থাকে, তবে কখনোই ধ্বংস হয়ে যায় না। যখনই এটি ভেঙে যাবার উপক্রম হয়, আমরা এটিকে পুনর্গঠন করি। কারণ আমাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন। সাহিত্য এই আশ্রয় প্রদান করে। সকল প্রকারের আশ্রয়।
সময় গড়িয়ে যায়। অব্যক্ত কথাগুলো একটা সমঝোতায় পৌঁছায়। আমাকে ‘লেখক-কর্মী’ বলে সম্বোধন করা শুরু হয়েছিল। এই ক্যাটাগরিতে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। ধারণাটা এমন ছিল যে, গল্প কখনোই রাজনৈতিক হবে না এবং রচনাগুলো কখনোই সাহিত্যনির্ভর হবে না।
ভাইস চ্যান্সেলর আমার কানে চুপি চুপি বললেন, “আপনার ফিকশনের উপর সময় নষ্ট করা উচিত নয়। বরং আপনার রাজনৈতিক লেখালিখির উপর মনোযোগ দেয়া উচিত।” কবিতার অধ্যাপক চুপি চুপি বললেন, “কবে আবার আপনি ফিকশন লেখা শুরু করবেন? এটিই তো আপনার সত্যিকারের ধ্যান-জ্ঞান।
হায়দ্রাবাদের একটি কলেজের লেকচার হলের কথা মনে পড়ে যেখানে দর্শক হিসেবে ছিল পাঁচশ থেকে ছয়শত ছাত্রছাত্রী। আমার বাম পাশে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, যিনি এই ইভেন্ট এর আয়োজন করেন। আমার ডানে ছিলেন কবিতার অধ্যাপক। ভাইস চ্যান্সেলর আমার কানে চুপি চুপি বললেন, “আপনার ফিকশনের উপর সময় নষ্ট করা উচিত নয়। বরং আপনার রাজনৈতিক লেখালিখির উপর মনোযোগ দেয়া উচিত।” কবিতার অধ্যাপক চুপি চুপি বললেন, “কবে আবার আপনি ফিকশন লেখা শুরু করবেন? এটিই তো আপনার সত্যিকারের ধ্যান-জ্ঞান। আর আপনার অন্যান্য লেখাগুলো শুধু ক্ষণকালের জন্য রচিত।”
আমি কখনোই ভাবি নি যে আমার ফিকশন এবং নন-ফিকশনগুলো সংঘাত ও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাবে শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্য। এরা কখনোই এক না অবশ্যই, তবে এদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করার চেষ্টা করা আমার কাছে কল্পনা করার চেয়েও কঠিন। বাস্তব বা প্রকৃত ঘটনা এবং গল্প বিপরীতমুখী নয়। এই সকল গল্প পুরোপুরি সত্য হবার দরকার হয় না। তবে অনেক বেশি বাস্তব হয়ে থাকে অন্যান্যগুলোর তুলনায়। অথবা এমনকি, আমার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, আমার ফিকশনগুলো ব্যাপক আকারে পঠিত হয় অন্যান্যগুলোর তুলনায়। যা-ই বলি না কেন যখন আমি লিখতে থাকি আমার পুরো শরীর জুড়ে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে।
দুইজন অধ্যাপকের মাঝে বসে আমি তাদের বিপরীতমুখী উপদেশ ভীষণ উপভোগ করছিলাম। আমি সেখানে হাসিমুখে বসে চিন্তা করছিলাম জন বার্গার’র কাছ থেকে পাওয়া প্রথম বার্তার কথা। এটি ছিল খুব সুন্দর হাতে লিখা একটি চিঠি। যিনি পাঠিয়েছিলেন তিনি ছিলেন যুগ যুগ ধরে আমার নায়ক। সেই চিঠিতে লিখা ছিল : “আপনার ফিকশন এবং নন-ফিকশন, আপনার চারপাশের দুনিয়ায় হেটে বেড়ায় ঠিক আপনার পা দু’খানির মতোই।”
যাইহোক, যে মামলাটি আমার বিপক্ষে করার কথা ছিল সেটি আর হয় নি অথবা কারও কোনো স্বার্থসিদ্ধি হয়নি। আমি এখন পর্যন্ত আপনাদের সামনে আমার দুটি পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। তবে আমার লেকচারার বন্ধু জাতি-বিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অভিযোগে কারাগারে আটক অবস্থায় আছেন। ভারতের কারাগারগুলো রাজনৈতিক বন্দীদের আষ্টেপৃষ্টে বেধে রাখে। এদের বেশিরভাগ মাওবাদী অথবা ইসলামি সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত। এই টার্মগুলোকে ব্যাপকভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় এবং যারা সরকারের নীতির বিপক্ষে দ্বিমত পোষণ করবে তাদেরকেই এ সকল সংজ্ঞার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
ফ্যাসিবাদীদের ভালো ফিকশন রাইটিং কোর্সগুলো করা উচিত।
প্রাক-নির্বাচনের সর্বশেষ দল প্রধানমন্ত্রী মোদিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে শিক্ষক, আইনজীবী, কর্মী এবং লেখকবর্গকে আটক করে। এই অভিযোগটি এতটাই হাস্যকর যে একটা ছয় বছরের বাচ্চাও এই প্লটের যথেষ্ঠ বিকাশ ঘটাতে পারবে। ফ্যাসিবাদীদের ভালো ফিকশন রাইটিং কোর্সগুলো করা উচিত।
রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস প্রকাশ করে পৃথিবীতে সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ জায়গার মধ্যে ভারত পঞ্চম অবস্থানে আছে। এর উপরে অবস্থান করছে আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন, এবং ম্যাক্সিকো। এখানে আমি অবশ্যই PEN কে ধন্যবাদ জানাই কেননা এই সংগঠনটি লেখক এবং সাংবাদিকদের যারা বন্দী, অভিযুক্ত, সেন্সরড এবং খারাপ অবস্থায় আছে তাদেরকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। আজ অথবা কাল, যে কোন দিন আমাদের যে কেউই এই অগ্নিমুখে পতিত হতে পারি। এরকম পরিস্থিতিতে একটি সংগঠন আছে যা আমাদের দেখভাল করে এটিও আমাদের জন্য অনেক বড় সান্ত্বনা।
ভারতে যারা কারাগারে বন্দী আছেন তাদের ভাগ্যবান বলতে হয়। এর থেকে কম ভাগ্যবানরা নিহত হয়েছেন। গৌরি লাঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভোল্কার, এমএম কালবুর্গি এবং গোভিন্দ পানসারে এই সকল সমালোচকরা খুন হয়েছেন। এগুলো ছিল হাই-প্রোফাইল হত্যাকাণ্ড। অন্যান্য কর্মীরা যারা তথ্য অধিকার নিয়ে কাজ করে এবং বড় বড় দুর্নীতির স্ক্যান্ডালগুলো যখন উন্মোচন করে দেয় তাদেরকে হত্যা করা হয় অথবা রহস্যজনক অবস্থায় এদের মৃত উদ্ধার করা হয়। গত পাঁচ বছরে, ভারত একটা নিপীড়ক জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মুসলমান এবং দলিতদের হিন্দু কট্টরপন্থীরা দিনের আলোয় প্রকাশ্যে প্রহার করে এবং পিটিয়েও মেরে ফেলে। তারপর সেই সকল ‘নিপীড়নের ভিডিও’ উল্লাসের সাথে ইউটিউবে আপলোড করে। যদিও মুসলমানদের বিপক্ষে এই সকল সহিংসতা নতুন নয় এবং দলিতদের বিপক্ষে সহিংসতাও প্রাচীন আমলের ঘটনা। এই সকল নিপীড়ন, সহিংসতার একটা পরিষ্কার ভাবাদর্শগত শক্ত সমর্থন আছে।
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রীয় সাংয় সেবক সংঘ (RSS), ভারতের সবচেয়ে গোপনীয় এবং শক্তিশালী সংগঠন। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে। এর প্রতিষ্ঠাকালীন ভাবাদর্শ ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। তারা প্রকাশ্যে হিটলার এবং মুসোলিনির প্রশংসা করে এবং ভারতীয় মুসলমানদের ‘জার্মানের ইহুদীদের’ সাথে তুলনা করে।
এই সকল নিপীড়করা ভালো করেই জানে যে সর্বোচ্চ জায়গা থেকে তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। এই সুরক্ষা কেবল সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে পায় তা নয় বরং একটি সংগঠন যা তাদের উভয়কেই নিয়ন্ত্রণ করে। যতদূর সঠিক, এই আদি-ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রীয় সাংয় সেবক সংঘ (RSS), ভারতের সবচেয়ে গোপনীয় এবং শক্তিশালী সংগঠন। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে। এর প্রতিষ্ঠাকালীন ভাবাদর্শ ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। তারা প্রকাশ্যে হিটলার এবং মুসোলিনির প্রশংসা করে এবং ভারতীয় মুসলমানদের ‘জার্মানের ইহুদীদের’ সাথে তুলনা করে। ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করার পক্ষে এই সংগঠনটি বিরতিহীনভাবে পঁচানব্বই বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। সেই সাথে ভারতের মুসলমান, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টদের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে।
এই সংগঠনটি (RSS) সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় দশ হাজারের মতো শাখা পরিচালনা করে এবং বিভিন্ন নামে কিছু কিছু সংগঠনগুলো পুরো দেশ জুড়ে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা ঘটায়।
ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিম উপকূলের ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত এরাই আজকের RSS সংগঠনটা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে গোটা ভারত। এই সংগঠনটি ইউনাইটেড স্টেট এবং ইউরোপ থেকে প্রভাবিত হয়ে আধিপত্যবাদী এবং বর্ণবাদী হয়ে উঠেছে। এরা হিন্দুবাদের প্রাচীন বর্ণ-প্রথা চর্চার ভূয়সী প্রশংসা করে রচনা সম্পাদন করে।
একটি পাশবিক সমাজব্যবস্থার যাজকবর্গ যারা এর বিস্তৃত, প্রাতিষ্ঠানিক নিষ্ঠুরতা নিয়ে অহংকার করে যা কম বা বেশি অরক্ষিত অবস্থায় টিকে আছে সেই প্রাচীন কাল থেকে- এটিই ব্রাহ্মণ্যবাদি ধর্ম হিসেবে অধিক পরিচিত। সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গায় এই ব্রাহ্মণ্যবাদি ধর্মের ভক্তের দেখা পাওয়া যায়। এদের একজন হলো, আপনি জেনে কষ্ট পাবেন, তিনি হলেন মোহনদাস গান্ধী। যিনি এই বর্ণ প্রথাকে হিন্দু সমাজের ‘জিনিয়াস’ হিসেবে বিবেচনা করতেন। আমি বর্ণপ্রথা এবং জাতি সম্পর্কে গান্ধীর আচরণের উপর একটি বই লিখেছিলাম যার নাম ‘দ্য ডক্টর এন্ড দ্য সেইন্ট’। সুতরাং আমি এখন এর উপর আর বিশেষ কিছুই বলব না।
১৯১৬ সালে মাদ্রাসের এক মিশনারী কনফারেন্সে গান্ধী বলেছিলেন, “বর্ণপ্রথার এই বিশাল সংগঠন কোন কমিউনিটির শুধুমাত্র ধর্মীয় চাওয়া থেকে উৎপন্ন হয়নি, বরং এটির রাজনৈতিক চাহিদা থেকে এর জন্ম হয়েছে। গ্রামবাসীরা তাদের অন্তর্গত বিষয়গুলো সামাল দিতো এই বর্ণপ্রথার মাধ্যমেই এবং এর মাধ্যমেই এরা শাসকবর্গের অত্যাচার মোকাবেলা করতো। এটি অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে একটি জাতির সাংগঠনিক সামর্থ্যই হলো বর্ণপ্রথা সৃষ্টির যোগ্যতা অর্জন করা এবং এটিই হলো সংগঠনের চমকপ্রদ ক্ষমতা।”
আজকে আরএসএস দম্ভ করে তাদের প্রশিক্ষিত ছয় হাজার সৈন্যবাহিনী নিয়ে গর্বের সাথে নিজেদের স্বয়ংসেবক’র সদস্য হিসেবে দাবি করে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার অধিকাংশ মন্ত্রীপরিষদও এই সংগঠনের সাথে জড়িত। বর্তমান ক্ষমতায় থাকা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আরএসএস’র সংসদীয় রাজনৈতিক পরিষদ হিসেবে কার্যাবলী সম্পাদন করে। এর সচিব রাম মাদভ আরএসএস এর একজন সদস্য। বাহ্যিকভাবে বিজেপিকে একটি স্বাধীনসত্ত্বা, খুবই সাধারণ, ডানপন্থী, রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে ভাবা যায় যা অজ্ঞাতসারে অথবা জ্ঞাতসারে আরএসএস’র সাথে জৈব সংযোগ কমিয়ে আনছে। ভারতের অনেকেই এবং আন্তর্জাতিক মাধ্যম নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদার হিসেবে দাবি করে, রাজনৈতিক ক্ষমতার পথে প্রবেশের পথটা সহজ করে নিয়েছে।
মোদির মূলধারার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল, কাকতালীয়ভাবে (অথবা হয়তো বা নয়) ৯/১১ এর কিছু সপ্তাহ পরে, যখন তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান, যদিও তিনি বিধানসভা থেকে নির্বাচিত হননি। তার মন্ত্রী পদে আসীন হবার কয়েকমাসের মধ্যে তার নেতৃত্বেই গুজরাটে মুসলমানদের বিপক্ষে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে, যেখানে প্রকাশ্যে দিবালোকে দুই হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিল। সেই মাসেই তিনি আবার নির্বাচন ডাকেন এবং জয়ী হন। গুজরাটের ব্যবসায়ীবৃন্দ এবং শিল্পপতিগণ, ভারতের বড় বড় কর্পোরেটের সিইওরা মোদিকে প্রকাশ্যে তাদের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন জানান। ফ্যাসিবাদ এবং পুঁজিবাদ বিবাহের মতো চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং একসাথে পথ চলে। পর পর তিনবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হবার পর ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। তাকে নায়কোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং তিনি বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। বিশ্বের বড় বড় নেতাবৃন্দ বারাক ওবামা এবং ইমানুয়েল ম্যাকরণ এবং অবশ্যই ডোনাল্ড ট্রাম্প তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। তবে এটি কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়।
মোদি সম্পর্কে এদের কেউই অজ্ঞাত নন বরং এক লক্ষ কোটিরও বেশি জনগণের বিপণন কেন্দ্রে তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বিক্রি করেন। বর্তমানে বিদ্বেষপূর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পাঁচ বছর পরে এই মোদি এবং তার দল আবার পুননির্বাচন দাবি করছেন।
অরুন্ধতী রায়ের নতুন বই। মাই সিডিসিয়াস হার্ট। এটি তার নির্বাচিত প্রবন্ধের সংকলন
প্রার্থীদের মধ্যে সাধভী প্রাজ্ঞ একজন যাকে সন্ত্রাসী হামলায় অংশগ্রহণ করায় এবং ছয়জন লোককে হত্যা করার অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়েছিল এবং বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানেকা গান্ধী মোদির মন্ত্রিসভার একজন ইউনিয়ন মন্ত্রী যিনি জনসম্মুখে একটি ভাষণে বলেছিলেন, গ্রামের উন্নয়ন করতে হবে যাদের ভোটে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। এবং তাদের আনুগত্যের সমানুপাত অনুযায়ী তাদের “উন্নয়ন” পুরস্কার অথবা শাস্তি দিতে হবে। বিষয়টি এমন নয় যে তিনিই একমাত্র এই ভাষায় বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি একমাত্র ব্যক্তি নন যিনি বলেছিলেন যে দল ভালো করেই জানে কারা ভোট দিয়েছে এবং কারা ভোট দেয় নি; এবং সেভাবেই প্রতিফল দেয়া হবে। এবং তিনি আরও ইঙ্গিত দেন যে রাজনৈতিক দলগুলোর ডাটায় প্রবেশাধিকার আছে যাকে গোপন ব্যালট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ডাটা তারা তাদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে যা সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্র এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে দেয়।
পুঁজিবাদের অতন্দ্র তত্ত্বাবধানের এই যুগে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের আমাদের সম্পর্কে সবকিছুই ওয়াকবিহাল থাকে। এবং এ সমস্ত তথ্যগুলো তারা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে কাজে লাগায়।
ভারত তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়ে যাচ্ছে। এমন কি বিজেপি তাদের সকল রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে টাকা লগ্নি করা সত্ত্বেও এবং কম বা বেশি মূলধারার মিডিয়া সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সত্ত্বেও যদি নির্বাচনে হেরে যায় এর ক্ষমতা বহাল থাকবে। এর মানে আমরা বিপদমুক্ত হব তা কখনও ঘটবে না। এই আরএসএস (RSS) বহুরূপী এবং সুবিধাবাদী। এটি লক্ষ কোটি পায়ে বিচরণ করে। পাঁচ বছর পূর্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ বিজেপি ক্ষমতা দখল করে এবং সেই সাথে এই সংগঠনও গতিশীলতা লাভ করেছে। তবে নিছক একটা নির্বাচনে হেরে গেলেও এদের নরকের দিকে অবিরাম যাত্রা কেউই ঠেকাতে পারবে না। এই সংগঠনটি যখন ইচ্ছেমতো রঙ পরিবর্তন করতে পারে। যখন প্রয়োজন হয় মুখোশ পরিধান করে থাকে। এটি গোপনে এবং প্রকাশ্যে কাজ করার সামর্থ্য প্রমাণ করেছে। এটি একটি ধৈর্যশীল, কঠোর পরিশ্রমী সংস্থা যার দেশের প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান- আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া, নিরাপত্তা বাহিনী, এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে গোপন আস্তানা রয়েছে।
যদিও একটা নতুন প্রশ্ন উঠেছে, যদি বিজেপি সরকার শপথ গ্রহণ না করে তা হলে কি হবে?
খুব সম্ভবত একটি সহনশীল জোট হবে— যাকে শিল্পজাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হিংস্র আক্রমণের মুখোমুখি হতে হবে এবং এরকম পরিস্থিতির সাথে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাব। তখন মহাসড়কে গরুর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যাবে, মন্দিরে পাওয়া যাবে গরুর মাংস এবং মসজিদের দিকে ছুড়ে ফেলা হবে শূকরের মাংস। যখন দেশ জুড়ে আগুন জ্বলতে থাকবে এই আরএসএস সংগঠনটি আমাদের সামনে নিজেদের উপস্থিত করবে ‘বিশৃঙ্খলাপূর্ণ –রাষ্ট্র’র কেবল একমাত্র উদ্ধারকর্তা এবং সমস্যা সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারার যোগ্য সংগঠন হিসেবে। এই সকল চাতুর্যপূর্ণ খেলার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল কি গভীরভাবে রাষ্ট্রের সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করতে পারে? এটি বলা আসলেই কঠিন।
দীর্ঘ বছর ধরে আমার লেখায় ফিকশন এবং নন-ফিকশনে এসব কথাই উঠে এসেছে।
১৯৯৭ সালের এক সামারে ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি ছিল একটি ভাষা নিয়ে গবেষণার ফসল। এবং এখানে যে জগতে আমি বেড়ে উঠেছিলাম এবং যাদেরকে আমি ভালোবেসে ছিলাম, কেরালার সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত কয়েকজন মানুষ – এসব কিছুই একটা নির্দিষ্ট ফর্মে বর্ণনা করেছি।
আমি স্থাপত্য নিয়ে অধ্যয়ন করেছিলাম, চিত্রনাট্য লিখেছিলাম এবং তারপর একটা উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম। উপন্যাস কেবলই উপন্যাস হতে হবে- এটি এমন কোনো উপন্যাস হবে না যা একটি ফিল্ম অথবা ম্যানিফেস্টো অথবা সামাজিক চুক্তিতে রূপান্তরিত হবে। যখন কিছু সমালোচক আমার প্রথম উপন্যাসকে জাদুবাস্তব বলে অভিহিত করেন আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম— এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে?
সেই উপন্যাসে উল্লিখিত জায়গাটি হলো আয়েমেনেমের পাহাড়ের উপর পুরাতন বাড়ি, আমার নানির আচারের ফ্যাক্টরি। যেখানে আমার বেড়ে ওঠা (এখনও আমার কাছে কিছু বয়াম এবং লেবেল আছে), সেই মেনাচল নদী- সবকিছুই আজও আমার কাছে জীবন্ত বাস্তবতা, যা কি না পশ্চিমা সমালোচকদের কাছে উদ্ভট এবং রূপকথা। যথেষ্ঠ হয়েছে। তবে আমারও নিউ ইয়র্ক এবং লন্ডন নিয়ে আমার মতো করে চিন্তা করার অধিকার আছে।
কেরালায় যখন ফিরে যাই, আমার অভ্যর্থনা খুব বেশি মসৃণ ছিল না। ১৯৫৯ সাল থেকে অনিয়মিতভাবে কমিউনিস্ট পার্টি কেরালা শাসন করেছিল। এই দলটি ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ এই উপন্যাসে দলের সমালোচনা করায় কিছুটা বিচলিত হয়েছিল।
আমি খুব দ্রুতই স্বদেশবিরোধী তকমাটা পেয়ে গেলাম। আমার কান্না- কথা-ঘুম-হাটা সবকিছুই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সামিল।
এটি সত্যি যে আমি অনেক বেশি জটিল ছিলাম, এবং আমার সমালোচনামূলক প্রবন্ধে কঠোর সমালোচনা করেছিলাম বামপন্থীদের। এই দল দ্বারা আমি ভারতের অসংখ্য কমিউনিস্ট দলকে বুঝি। বর্ণপ্রথাকে ঘিরে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কোনো জটিলতা নেই। বরং এরা প্রকাশ্যে এবং স্পষ্টতই অতিরিক্ত মাত্রায় জাতিভেদের সাথে জড়িত।
এই উপন্যাসে আম্মু (একজন সিরিয়ান খ্রিস্টান মহিলা) এবং ভেলুথার (একজন দলিত সম্প্রদায়ের লোক) অপরাধমূলক সাম্প্রদায়িক সম্পর্কটিকে আতঙ্কের দৃষ্টিতে দেখা হয়। এই উপন্যাসে হতবুদ্ধি বা হতবিহবল হয়ে যাওয়ার মতো সম্পর্কটিকে ঘিরে বর্ণপ্রথার রাজনীতির চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এখানে অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র কমরেড কেএনএম পিল্লাই এর সাথে তার সহধর্মিণী কল্যানী এবং একজন ডিভোর্সি মহিলা, আম্মুর সম্পর্কটিকে চিত্রায়িত করা হয়েছে “মাতৃত্বের অপার ভালোবাসা এবং আত্মঘাতী হামলার বেপরোয়া আক্রোশ এর সমন্বয়ে।”
“রাতের অন্ধকারে অন্য নারীর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করা এবং দিনের আলোয় ঐ নারীর সন্তানের কাছ থেকে সহমর্মিতা পাওয়া” একে সাধুবাদ এবং স্তুতিগাথার সাথে গ্রহণ করা হয়নি। পাঁচজন পুরুষ আইনজীবী একত্রিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অশ্লীলতা এবং ‘জনসাধারণের নৈতিকতা দূষণের’ দায়ে অভিযুক্ত করে ফৌজদারি মামলা করে।
উপন্যাসের বাইরেও এই বিষয়গুলো অনেক বেশি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম তখন। আমার মা, মেরি রায় সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলায় জিতেছিলেন যা সিরিয়ান খ্রিস্টিয়ান উত্তরাধিকার আইনকে অনেকখানি নিশ্চল করে দিয়েছিল, যেখানে একজন নারী পেতেন ‘তার পিতার সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ অথবা পাঁচ হাজার রুপি যা কিছুটা কম।’ বর্তমানে মহিলারা উত্তরাধিকার সূত্রে সমান ভাগ পেয়ে থাকে। এটি অনেকের ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন অনেকের একটা তীব্র প্রতীয়মান অনুভূতি ছিল যে মা এবং মেয়ের একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। ঠিক সেই সময় তৃতীয় অথবা চতুর্থ শুনানির সময় ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ বুকার প্রাইজ লাভ করে। যা জনমতকে বিভক্ত করে তোলে। একজন লোকাল মালয়লাম নারী, সম্মানজনক আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরষ্কার বিজয়ী তার জন্য বিষয়টি অত সহজে মীমাংসিত হবার নয়। এখন তার কি এই মামলাটি এড়িয়ে যাওয়া উচিত অথবা সাড়া দেওয়া উচিত? আমি যখন আমার আইনজীবীকে নিয়ে কোর্টে হাজির হলাম, তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন যে আমার বইয়ের কিছু অংশ ‘সম্পূর্ণ অশ্লীল’। তবে আইন অনুযায়ী, একটি শিল্পের পুরো কাজের উপর ভিত্তি করেই বিচার করা উচিত এবং যেহেতু পুরোটা অশ্লীলে পরিপূর্ণ নয়, আমাদের লড়াই করার একটা সুযোগ আছে। বিচারক বললেন, “প্রত্যেকবার যখনই এই মামলাটি আমার সামনে আসে, আমার বুকে ব্যাথা অনুভব হয়।” তিনি এই মামলার শুনানি স্থগিত করলেন এবং পরবর্তীতে যে বিচারকগণ আসলেন তারাও একই কাজ করলেন। ইতোমধ্যে লোকজন এই উপন্যাসের- ভাষা, শৈশবের হাতছানি এই সাধারণ বিষয়গুলোকে সেলিব্রেট করা শুরু করলো।
এখন পর্যন্তও আম্মু এবং ভেলুথার সম্পর্কটিকে আঁতকে না ওঠে, স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়াটা অনেকের জন্যই আজও কঠিন। দশ বছর পূর্বে মামলাটির সমাধান হয়ে গেছে।
১৯৯৮ সালের মে মাসে, ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ প্রকাশের অল্প কিছু দিন পরেই ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিজেপি পরিচালিত সংগঠন থেকে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হয়েছিল। সেই সময়, প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী এই আরএসএস’র সদস্য ছিলেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যেই, তিনি ধারাবাহিকভাবে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা পরিচালনা করে আরএসএস’র দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করেন। পাকিস্তানও সাথে সাথে পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়ে এর জবাব দেয়। এই পারমাণবিক পরীক্ষাগুলো শুরু থেকেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চরম অলঙ্কারে রূপ নেয় যা বর্তমানে ভারতে পাবলিক স্পিচের অন্যতম সাধারণ বিষয় হিসেবে ব্যাবহৃত হয়।
সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দলগুলোও যখন পারমাণবিক পরীক্ষা (Nuclear Test) উন্মত্ত উল্লাসের সাথে উদযাপন করে- তখন আমি সত্যিকার অর্থেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। এই পারমাণবিক পরীক্ষাকে নিন্দা জ্ঞাপন করে আমি আমার প্রথম রচনা লিখি ‘দ্য এন্ড অব ইমাজিনেশন’।
আমি বলেছিলাম যে পারমাণবিক প্রতিযোগিতার যুগে প্রবেশকরণ আমাদের চিন্তাভাবনা কল্পনাকে ঔপনিবেশিক করে দিয়েছে। আমি লিখেছিলাম, ‘যদি ভারত- বিরোধী এবং হিন্দু – বিরোধী পারমাণবিক বোমা আমার মস্তিস্কের ভিতরে প্রতিস্থাপন করা যায়; তবেই আমি ক্ষান্ত হব। এরই ধারাবাহিকতায় আমি নিজেকে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক বলে ঘোষণা করি।’
এখন আমি যে কথাগুলো বলব তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আপনারা নিজেরাই চিন্তা করবেন।
সকলের জন্য কি সাহিত্য রচিত হয় ? এমন কি যারা পড়তে এবং লিখতে পারে না। তবে কে আমাকে শিক্ষা দিবে কিভাবে চিন্তা করতে হয় এবং কিভাবে অধ্যয়ন করা যায়?
‘দ্য এন্ড অব ইমাজিনেশন’ ছিল আমার প্রথম রচনা যা বিগত বিশ বছর ধরে আমাকে নন ফিকশন রচনা লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই রচনাগুলো যখন লিখছিলাম তখন ভারত তড়িৎগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছিল। প্রত্যেকটি রচনার জন্য আমি সঠিক ভাষা, গঠনপ্রণালী অনুসন্ধান করতাম। আমার প্রত্যেকটি নন ফিকশন ছিল বর্ণনামূলক। আমি কি বাধ্যতামূলক ভাবে সেচপ্রকল্প নিয়ে লিখতাম যেখানে আমি ভালোবাসা, বিচ্ছেদ এবং শৈশব নিয়েও লিখতে পারতাম? মাটির লবণাক্ততা নিয়ে লিখতে বাধ্য ছিলাম? অথবা বাধ, শস্য, নিষ্কাসন, বেসরকারিকরণ, বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের খরচ বা যে সকল জিনিস সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে প্রভাবিত করে- এসকল বিষয় নিয়ে লিখতে বাধ্য ছিলাম? তথ্যমূলক নয় বরং গল্প বলার ঢঙে উপস্থাপন করা উচিত ছিল কি? এই বিষয়বস্তুগুলোকে সাহিত্যে রূপান্তর করা সম্ভব ছিল কি? সকলের জন্য কি সাহিত্য রচিত হয় ? এমন কি যারা পড়তে এবং লিখতে পারে না। তবে কে আমাকে শিক্ষা দিবে কিভাবে চিন্তা করতে হয় এবং কিভাবে অধ্যয়ন করা যায়?
আমি চেষ্টা করেছিলাম। এবং যখনই রচনাগুলোর কথা মনে হতো, পাঁচজন পুরুষ আইনজীবীর কথাও স্মরণ হতো (সেই একই আইনজীবী নন, ভিন্ন ভিন্ন, তবে মনে হতো তারা একই সাথে তাড়া করছে)। এবং সেই ফৌজদারি মামলাগুলো, যার বেশিরভাগই আদালতের অবমাননার অভিযোগে করা হয়েছিল। এগুলোর একটি শেষ হয়েছিল সংক্ষিপ্ত কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা দিয়ে, অন্যগুলো এখনও বিচারাধীন আছে। তর্কগুলো সবসময়ই বিদ্বেষমূলক ছিল। মাঝেমধ্যে সহিংসপূর্ণ হতো। তবে তর্কের বিষয়গুলো সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
প্রত্যেকটা রচনা লেখার পর এমন ঝামেলায় পড়তাম তখন নিজের সাথে নিজেই পরবর্তীতে আর না লেখার জন্য ওয়াদা করতাম। তবে অবধারিতভাবে, পরিস্থিতি এরকম হয়ে ওঠতো যে নিজেকে সম্পূর্ণ শান্ত রাখার সব রকমের চেষ্টা আমার মস্তিস্কের ভেতর প্রচণ্ড শব্দ দূষণ তৈরি করতো, আমার রক্তের ভেতরে একরকম যন্ত্রণা শুরু হতো যার ফলে আমি পরাজয় মেনে নিয়ে আবার লেখা শুরু করতাম। গত বছর আমার প্রকাশকেরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন সব রচনাগুলো একক ভলিউমে নিয়ে আসার জন্য। আমি হাজার পৃষ্ঠা সম্বলিত দীর্ঘ কালেকশন ‘মাই সেডিসাস হার্ট’ দেখে ভীষণ বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম।
লেখালিখির বিশ বছর অতিক্রম হওয়ার পর, অসংখ্য বিদ্রোহী হৃদয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার সুবাদে, অসাধারণ এবং অতি সাধারণ ও চমৎকার কিছু মানুষের সাথে দেখা হওয়ার সুবাদে সেই ফিকশনে আবার ফিরে যাই।
একটা ব্যাপার সম্পূর্ণ পরিষ্কার যে, উপন্যাসে একটি মহাবিশ্ব ধারণ করা সম্ভব যা ধীরে ধীরে আমার ভেতরে গড়ে উঠেছিল। যে পৃথিবীতে আমার বেড়ে ওঠা সেখান থেকে আমি হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই এবং আমার ভেতরে একটা আলাদা গল্পের জগতে তৈরি হয়। আমি জানতাম এই ভুবন হতে পারে অযৌক্তিকভাবে জটিল, অপ্রকাশিতভাবে রাজনৈতিক এবং অপ্রচলিতভাবে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। আমি জানতাম যদি ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ একটি আবাসস্থল হয় তবে এর ভিতরের পরিবারের সদস্যরা হবে ভগ্ন হৃদয়ের।
বিশেষ করে কাশ্মিরে, যেখানে কেবল গল্প বা ফিকশন সত্যি হতে পারে কেননা সত্য কখনও সেখানে প্রকাশ করা যায় না। ভারতে, শারিরীক ক্ষতির ঝুঁকি ছাড়া সত্য কথা বলা সম্ভব নয়।
এই আবাসস্থলের ছাদ যখন বিধ্বস্ত হয়ে যাবে এবং ভগ্ন হৃদয়ের লোকজন ছিন্নভিন্ন হয়ে যুদ্ধ— বিধ্বস্ত উপত্যকা এবং শহরের রাস্তাগুলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে এবং তখনই ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’র সূচনা হবে। এটি উপন্যাস হতে পারে, তবে গল্পের ভুবন সব রকমের রীতিনীতি প্রত্যাখ্যান করে যা উপন্যাসে থাকতেও পারে আবার নাও পারে। আমার বিশ্বে এটি একটি বিশাল বড় শহর যেখানে পাঠকেরা হাজির হয় নতুন অভিবাসী হিসেবে। সেখানে কিছুটা ভয় থাকবে, কিছুটা আতঙ্ক এবং প্রচুর উত্তেজনা থাকবে। এই ভুবন সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায় হলো এর ভেতরে হেটে বেড়ানো, কখনো হারিয়ে যাওয়া এবং বেচে থাকতে শিখা। ছোট বড় সব রকমের মানুষের সাথে দেখা করতে জানতে হবে। ভীড়কে ভালোবাসতে জানতে হবে। দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস একটি উপন্যাস হতে পারে কেননা এখানে যা বলা সম্ভব অন্যথায় তা বলা সম্ভব না। বিশেষ করে কাশ্মিরে, যেখানে কেবল গল্প বা ফিকশন সত্যি হতে পারে কেননা সত্য কখনও সেখানে প্রকাশ করা যায় না। ভারতে, শারিরীক ক্ষতির ঝুঁকি ছাড়া সত্য কথা বলা সম্ভব নয়।
ভারত এবং কাশ্মি, কাশ্মির এবং ভারত সম্পর্কে জেমস বল্ডীন’র উক্তি অপেক্ষা অধিকতর ভালো কিছু আমার জানা নেই এবং তারা কখনোই আমাকে বিশ্বাস করতো না কারণ খুব সম্ভবত এরা জানতো যে আমি যাই বলি সত্যি বলি। কাশ্মিরের গল্পটি মানবাধিকারের প্রতিবেদনগুলোর সমন্বয়ে রচিত হয় না। এটি শুধুমাত্র বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড, নিপীড়ণ, গুম অথবা নিপীড়িত লোকজন এবং অত্যাচারী স্বৈরশাসকগোষ্ঠীর গল্প নয়। কাশ্মিরে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিশেষ কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। একজন লেখকের জন্য, কাশ্মিরের মানব সত্ত্বা অনেক বড় শিক্ষার উৎস। ক্ষমতা, ক্ষমতাহীনতা, বিশ্বাসঘাতকতা, বিশ্বস্ততা, ভালোবাসা, বিশ্বাস, রসবোধ….. এর পৃথিবীতে যুগ যুগ ধরে সামরিক শাসনের অধীনে বসবাসকারী এই জনগণের সাথে আসলে কি ঘটে? ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশে যে সকল সন্ধিচুক্তি হয়েছিল সেগুলোর কি পরিণতি হয়? ভাষার সাথে কি ঘটেছে?
কাশ্মিরে যখন আমি ভ্রমণ করি তখন সর্বপ্রথম যে কাজটি করি তা হলো ‘কাশ্মিরি ইংরেজি বর্ণ’ সংগ্রহ করা যা ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ এ দেখানো হয়েছে। ‘A’ বর্ণ দিয়ে শুরু করা যাক :
A : আজাদী/আর্মি/আল্লাহ/আমেরিকা/
আক্রমণ/একে-৪৭/ গোলাবারুদ/সৈন্যদলের গোপন আস্তানা/ আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার এক্ট/ আল বদর/ আল মানসুরিয়ান/আল জিহাদ/ অমরনাথ ইয়াত্রা।
B: বিএসএফ/ বডি/ ব্লাস্ট/ বুলেট/ ব্যাটেলিয়ন/ কাঁটাতার(Barbedwir) / বর্ডার ক্রস/ বাইট/ বেগার।
C : ক্রস বর্ডার/ ক্রসফায়ার/ ক্যাম্প/ সিভিলিয়ান/ সান্ধ্য আইন(curfew)/ কঠোর ব্যবস্থা(crackdown)/ বেস্টনী(cordon)/ চেকপোস্ট/ বিদ্রোহ দমন(counter-insurgency)/ যুদ্ধবিরতি(ceasefire) / ক্যাচ অ্যান্ড কিল/ কাস্টোডিয়াল কিলিং/ সহযোগী(collaborator) এবং এরকম হাজারো…….
আবার ,
যে সকল লোকজন যারা প্রশাসন, ন্যায়বিচার পরিচালনা করে তাদের সাথে আদৌ কি ঘটে? যে সকল লোকজন— তাদের নামে এসকল অন্যায় যখন তারা প্রশ্রয় দিয়ে থাকে তাদের সাথে কি ঘটনা ঘটে? কাশ্মিরের পুরো বর্ণনাতে পাওয়া যায় একরকমের ধাঁধাঁর খেলা। তবে এটি শেষ প্রতিচ্ছবি নয়।
কিছু অচেনা লোকজন আমার লেখা অনুসরণ করে নিজেদের রাস্তা তৈরি করে নিয়েছে। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম হলেন বিপ্লব দাশগুপ্ত, একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসার। যখন তিনি আসলেন এবং কথা বললেন আমি কিছুটা বিচলিত হয়ে গেলাম। আমি তখন চিন্তা করলাম আমি হয়তো তার মস্তিষ্কের ভেতরে অবস্থান করছি। এবং পরক্ষণেই আমি উপলব্ধি করলাম যে সম্ভবত তিনি নিজেই আমার ভেতরে অবস্থান করছেন। তবে সবচেয়ে শিহরণের বিষয় হলো তার ভিলেইনি আচরণ নয় বরং তার যুক্তিবাদীতা, তার বুদ্ধিমত্তা, তার বিনয়ী আচরণ, তার অরক্ষণীয়তা।
এখনও, দাশগুপ্তের পাণ্ডিত্যপূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টি যা দেখতে পায় না ঠিক তাই সহজে দেখতে পারে ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ এর অন্যতম ক্ষুদ্র চরিত্র, বাসবভনের ঠিকাদার, মিস্টার ডি ডি গুপ্তা। মিস্টার গুপ্ত দীর্ঘ কয়েক বছর পর ইরাক থেকে ভারতে এসে পৌঁছান। তিনি ইরাকের বসবাসকারী বাসবভনগুলোর বিস্ফোরিত বিধ্বস্ত দেয়ালগুলোর ছবি তার মোবাইলে গর্ব সহকারে জমা করেন। তিনি ইরাকে বসবাসকালীন যা যা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, তাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং তার অর্জিত অভিজ্ঞতাসমূহ যদি তার নিজ দেশে ঘটতে শুরু করে তবে শেষ পর্যন্ত এর পরিণাম হবে ভয়াবহ অর্থাৎ বিস্ফোরিত ও বিধ্বস্ত দেয়ালসমূহের বিশাল মার্কেট গড়ে উঠবে।
উপন্যাসসমূহ তাদের গ্রন্থকারদের চূড়ান্ত উন্মাদনা এনে দিতে পারে, সেই সাথে তাদের লেখকদের আশ্রয়ও দিতে পারে।
একজন লেখক হিসেবে, আমি ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’র চরিত্রগুলোকে সুরক্ষা দিই, কেননা এগুলো অনেক বেশি অরক্ষিত। ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’র চরিত্রগুলোও অনেক বেশি অরক্ষিত। তারপরেও তারা আমাকে সুরক্ষা দেয়। বিশেষ করে আঞ্জুম, যার জন্ম হয়েছিল আফতাব হিসেবে, যার শেষ জীবন কাটে পুরাতন দিল্লির সীমানার বাইরের দিকে মুসলমানদের পরিত্যক্ত কবরস্থানে জান্নাত গেস্ট হাউসের মালিক হিসেবে। আঞ্জুম নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক, প্রাণী এবং মানবজাতি, এবং জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে সীমানাগুলোকে নমনীয় করে তোলে। এই ক্রমবর্ধমান দুর্ভেদ্য পৃথিবীর শোষণের কঠিন প্রাচীর থেকে বাঁচতে আশ্রয় নেয়ার যখন প্রয়োজন হয় তখনই আমি তার কাছে চলে যাই।
(সম্পাদকের নোট: তিনি যখন এই বক্তৃতা দিয়েছিলেন তখন ভারতের নির্বাচন চলছিল। নির্বাচনে আবারও উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপিই ক্ষমতায় এসেছে। এবং গুজরাটের গণহত্যার নায়ক মোদিই প্রধানমন্ত্রী। আর প্রতিদিনই ঘটছে মুসলিম হত্যা ও দলিতদের উপর অত্যাচারের ভংয়কর সব ঘটনা।)
দ্যাজবান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন