যেখানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ এমবিবিএস ডাক্তারের রোগী দেখার ফি ৫০০ থেকে ২০০০টাকা বা তার বেশি। সারাদেশে সেবার নামে চলছে ডাক্তারদের চিকিৎসা বাণিজ্য। অর্থের অভাবে ভালো ডাক্তার দেখাতে পারছেন না অনেকেই। সেখানে ভারতে এমন একজন এমবিবিএস ডাক্তারের খোঁজ মিলেছে যিনি কিনা মাত্র পাঁচ টাকা ভিজিটে দৈনিক দু’শ রোগীর চিকিৎসা করেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার এই ডাক্তারের নাম ডা. গৌরাঙ্গ গোস্বামী। যিনি অত্র অঞ্চলে ‘পাঁচ টাকার ডাক্তারবাবু’ নামেই পরিচিত। সম্প্রতি দেশটির স্থানিয় গণমাধ্যমে তার সম্পর্কে বিস্তারিত উঠে আসে।
অম্বিকা কালনা স্টেশনে নেমে তাঁর বাড়ি যাওয়ার কথা বললে ভাড়া নিতে চান না কোনও টোটোচালক। পাড়ায় ঢুকে নাম বলে বাড়ি চিনতে চাইলে এলাকাবাসীর চোখে–মুখে ফুটে ওঠে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। ‘ডাক্তারবাবুর’ অতিথির যাতে কোনও অসুূবিধা না হয়, তাই আগন্তুককে বাড়ি দেখিয়ে দিতে নিজের কাজ ফেলে উঠে আসেন প্রতিবেশীরা। তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইলে, কেউ বলেন সাক্ষাৎ ঈশ্বর, কেউ বলেন স্বয়ং ধন্বন্তরি। তিনি ডা. গৌরাঙ্গ গোস্বামী। কালনা এবং তার আশপাশের অঞ্চলে যিনি বিখ্যাত ‘পাঁচ টাকার ডাক্তারবাবু’ নামেও। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে যিনি যৎসামান্য পারিশ্রমিকে বা বিনা পারিশ্রমিকে রোগী দেখে চলেছেন এই অঞ্চলে। পাশাপাশি বামপন্থী রাজনীতিতে এখনও সক্রিয় কর্মী তিনি। কিন্তু রাজনৈতিক, ধর্মীয় কিংবা কোনও শ্রেণিগত বিভেদের কারণে এই চিকিৎসক কোনও দিন কোনও রোগীকে ফেরাননি বলে দরাজ ‘সার্টিফিকেট’ দিয়ে রাখছেন এলাকাবাসীরাও। বামপন্থী গৌরাঙ্গের প্রশংসায় পঞ্চমুখ স্থানীয় তৃণমূল কিংবা বিজেপি সমর্থকরাও। রাজনৈতিক হানাহানির এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাই কালনার ভূমিপুত্র গৌরাঙ্গ এক বিরল চরিত্র।
১৯৭৮ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন গৌরাঙ্গ। তারপরে ভর্তি হন ‘এমএস’–এর পঠনপাঠনে। কিন্তু সেই পড়াশুনো শেষ করতে পারেননি। কারণটা রাজনৈতিক। ততদিনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাই পরে উত্তরবঙ্গের একটি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরি পেয়েও কালনাতেই ফিরে আসেন তিনি। সেখান থেকেই শুরু। ন্যূনতম পারিশ্রমিকে রোগী দেখা শুরু করেন তিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় নানা জিনিসের দাম বাড়লেও গৌরাঙ্গের পারিশ্রমিক বেড়ে হয়েছে মাত্র পাঁচ টাকা! নিজের বাড়িতেই চেম্বার বানিয়ে রোগী দেখেন গৌরাঙ্গ। রোগীদের শুশ্রূষার ফাঁকে তিনি বলছিলেন, ‘ওই সরকারি চাকরিটায় যোগ দিলে বদলি হতেই হতো। কোথায় কখন থাকতে হতো কে জানে? কালনার মানুষের সেবা করার সুযোগ পেতাম কি না, সেটাও নিশ্চিত নয়। তাই ভাবলাম চাকরি ছেড়ে এখানেই প্র্যাক্টিস শুরু করা যাক।’ সকাল দশটা থেকে শুরু হয় গৌরাঙ্গের রোগী দেখা। দুপুর একটা পর্যন্ত রোগী দেখে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেন তিনি। তারপরে দুপুর তিনটে থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় তাঁর সময় কাটে রোগী–স্টেথোস্কোপ–প্রেসক্রিপশন নিয়ে। ফের এক ঘণ্টা বিশ্রাম। তারপরে সন্ধে ছ’টা রাত একটা–দেড়টা পর্যন্ত তাঁর কাছে ভিড় জমান রোগীরা। গৌরাঙ্গে জানালেন, ‘অনেক সময়েই বিশ্রামের সময়েই কোনও ইমার্জেন্সি কল এসে গেল। তখন তো আর চুপ করে বসে থাকা যায় না।’ বিশ্রামের সময় কাটছাঁট করেই নিজের মোটরবাইকে চড়ে রোগী দেখতে ছোটেন গৌরাঙ্গ। তিনি বলছিলেন, ‘রাত একটা পর্যন্ত রোগী দেখি মানে এমন নয় যে তারপরে রোগী এলে দেখব না। আমার বাড়ির দরজা রোগীদের জন্য সবসময়ই খোলা।’ দৈনিক দু’শো থেকে আড়াইশোজন রোগীর চিকিৎসা করতে হয় তাঁকে। কিন্তু মাত্র পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে সব সাংসারিক প্রয়োজন মেটে? গৌরাঙ্গ বললেন, ‘আমি যে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, তাতে এর চেয়ে বেশি টাকা লাগে না। তাছাড়া একজন কমিউনিস্টের জীবন এরকমই হওয়া উচিৎ। প্রয়োজনের বেশি উপার্জনের দরকার আমার নেই।’
এলাকায় গৌরাঙ্গের জনপ্রিয়তা কতটা সেটা বোঝা যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললেই। কালনা স্টেশন লাগোয়া দোকানের ব্যবসায়ী সাধন সাহার কথায়, ‘অনেকে ভাবেন, যে চিকিৎসকের পারিশ্রমিক কম, তিনি বোধহয় ততটা দক্ষ নন। কিন্তু গৌরাঙ্গবাবুর কাছে শুধু কালনা নয়, হুগলি ও নদিয়া এমনকী কলকাতা থেকেও রোগী আসেন। আমি এমনও দেখেছি, কলকাতায় নামজাদা চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা করিয়েও তাঁরা গৌরাঙ্গবাবুর কাছে এসেছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলেছেন, তাঁদের রোগের ব্যাপারে কলকাতার চিকিৎসকরা বিশদে কথা বলেননি। ওষুধ লিখে দিয়েই দায় সেরেছেন। গৌরাঙ্গবাবুর কাছে আসার পরে কী হয়েছে, কেন হয়েছে, রোগের অবস্থা কতটা গুরুতর— এসবই সহজভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। আবার কেউ হয়তো আত্মীয়স্বজনের চাপে কলকাতায় চিকিৎসা করিয়ে এসেছেন, তারপরে আবার ফিরে গৌরাঙ্গের কাছেই এসেছেন। কাগজপত্র দেখিয়ে জানতে চেয়েছেন, তাঁর ঠিক চিকিৎসা হয়েছে কি না! আসলে ওঁর ব্যবহার এতটাই ভাল যে কথা বললেই রোগী নিশ্চিন্ত হয়ে যান। অর্ধেক অসুখ তো ওখানেই সেরে যায়। তাছাড়া যত রাতই হোক, ওঁর কাছে কাছে কোনও রোগী গেছেন, তবু তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমনটা কখনও হয়নি।’ স্থানীয় গৃহবধূ রিনা সূত্রধর আবার বললেন, ‘গৌরাঙ্গবাবু সাক্ষাৎ ঈশ্বর। কম পারিশ্রমিকে চিকিৎসা ছাড়াও কত মানুষকে যে উনি বিনামূল্যে ওষুধ দিয়েছেন বা চিকিৎসার খরচের জন্য অর্থ সাহায্য করেছেন, সেটা গুনে শেষ করা যাবে না। এমনকী, পাঁচটাকা দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না যাঁদের, তাঁদের বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা করেন উনি।’ স্থানীয় বাসিন্দা সুভাষ পোদ্দারের কথায়, ‘শুধু পারিশ্রমিক কম নেওয়া কিংবা রোগীর সেবা করাটাই বড় কথা নয়। কালনায় এমন একজনও নেই, যিনি গৌরাঙ্গকে শ্রদ্ধা করেন না। অগ্নীশ্বর ফিল্মে উত্তমকুমার যে চিকিৎসকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, তিনি যেমন সর্বজনশ্রদ্ধেয় একটি চরিত্র ছিলেন, এখানে গৌরাঙ্গও তেমন।
ভাল ব্যবহারই যে তাঁর চিকিৎসার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, সেটা পরোক্ষে মেনে নিচ্ছেন গৌরাঙ্গ। তিনি বলছেন, অনেক চিকিৎসকই শুধু প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে কাজ সারেন। ব্যস্ততা হোক কী অন্য কোনও কারণ, তাঁরা রোগীকে সময় দিতে পারেন না। আমি মনে করি, চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক হওয়া উচিৎ। অসুখ হলে যে শুধু শরীরের ওপরে প্রভাব পড়ে, তাই নয়। মনও তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মন ভাল থাকলে শরীরও জলদি সেরে ওঠে।’
একসময় কালনা পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন গৌরাঙ্গ। ছিলেন জেলা কমিটির সদস্যও। বর্তমানে সিপিএম কালনা কমিটির সদস্য তিনি। রাজনীতি এবং চিকিৎসা— একসঙ্গে সামলান কী করে? গৌরাঙ্গ বললেন, ‘যখন যেটা করি, তখন সেটাই মন দিয়ে করি। তাহলেই দুটো কাজের ভারসাম্য বজায় রাখা যায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন