দিল্লিতে দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গে বিজেপির আলিশান সদর দফতরে দলের সাংবাদিক বৈঠক সবেমাত্র শেষ হয়েছে। বিজেপি নেত্রী তথা প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং দলের তাত্ত্বিক বাঙালি নেতা ও রাজ্যসভার এমপি স্বপন দাশগুপ্ত সবেমাত্র সেই সাংবাদিক সম্মেলনে ব্যাখ্যা করেছেন, কেন পশ্চিমবঙ্গে ভোট মিটে যাওয়ার পরেও কেন্দ্রীয় বাহিনী রেখে দেওয়া দরকার।
ততক্ষণে সারা দেশে ভোটগ্রহণ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। সীতারামন ও দাশগুপ্ত, দুজনেই দফতর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন – তারপর কী ভেবে আবার বসেই পড়লেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, একটু বাদে যে এক্সিট পোল বা বুথফেরত সমীক্ষার ফলাফলগুলো বিভিন্ন চ্যানেলে বেরোতে শুরু করবে সেটা না-হয় দলীয় কার্যালয়ে বসেই দেখবেন।
সিদ্ধান্তটা যে পুরোপুরি সঠিক ছিল, সেটা বোঝা গেল খানিকক্ষণের মধ্যেই। বিভিন্ন চ্যানেলের জরিপে – এবং সব পোলের গড়পড়তা হিসেবে, যাকে বলে ‘পোল অব পোলস’, তাতেও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট অনায়াসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে বা তার খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাবে বলেই পূর্বাভাস এলো।
গত দুমাসের উৎকণ্ঠা আর টেনশন-ক্লান্তি যার চোখেমুখে পরিষ্কার ছাপ ফেলেছে, সেই নির্মলা সীতারামনের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। একগাল হেসে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম!’
আর আনন্দটা যেন দ্বিগুণ ছিল স্বপন দাশগুপ্তর জন্য। অক্সফোর্ডে পড়া এই পন্ডিত নেতা ও পার্লামেন্টারিয়ান গত কয়েকমাস ধরে পশ্চিমবঙ্গে পড়ে থেকে বিজেপির হয়ে টানা প্রচার করে গেছেন। এক্সিট পোলগুলো যখন সমস্বরে জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির আসন সংখ্যা দুই থেকে বেড়ে অন্তত এগারোতে পৌঁছবে (টাইমস নাও এবং সি-ভোটার পোল), তার খুশিও যেন বাঁধ মানছিল না।
আরও এক ধাপ এগিয়ে জন-কি-বাত চ্যানেলের এক্সিট পোল তো বলেছে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ১৮ থেকে ২৬টির মতো আসন পাবে। আর রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল পিছিয়ে থাকবে, তাদের জুটবে বড়জোর ১৩ থেকে ২১টি আসন।
হাজার হলেও এগুলো এক্সিট পোল, নির্বাচনি ফলাফল নয়। অতীতে বহুবার দেখা গেছে, ভারতে বিভিন্ন এক্সিট পোলের রায় সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কখনও যে এক্সিট পোল মোটামুটি সঠিক পূর্বাভাস করেনি তা নয় – কিন্তু ভারতে এক্সিট পোলের রায়কে একটু ‘পিঞ্চ অব সল্ট’ নিয়ে দেখাই দস্তুর, অর্থাৎ কিনা মানুষ সেটাকে একটু অবিশ্বাস মিশিয়েই দেখতে অভ্যস্ত।
আর সে কারণেই বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রামলাল এক্সিট পোলের ফলাফলে চোখ বুলিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘আমরা খুশি অবশ্যই। নরেন্দ্র মোদির ওপর মানুষ যে আবার ভরসা রাখবেন তা নিয়ে আমাদের কখনওই বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না – আর সেটাই এখানে প্রতিফলিত হয়েছে।’
'তবে তার পরও বিজেপি কখনওই এক্সিট পোলের ওপর ভরসা করে বিজয়োৎসব শুরু করে দেয়নি – এবারেও আমরা তা করব না। আমরা ২৩ মে চূড়ান্ত ফলাফলের জন্যই অপেক্ষা করব, আর তার পরই দল প্রতিক্রিয়া দেবে’, বলছেন রামলাল।
এই কথোপকথনের মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিরোধী কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেড়াকে ফোন করে যে প্রতিক্রিয়া পেলাম, তা অবশ্য রীতিমতো হকচকিয়ে দেওয়ার মতো!
পবন খেড়াও দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে মিলে ২৪ আকবর রোডে কংগ্রেসের সদর দফতরে বসেই এক্সিট পোল দেখেছেন এবং রাগে ফুঁসছেন বললেও কম বলা হয়।
‘দেখুন, এই সব আজেবাজে পোল নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি এ দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে ও আরও নানাভাবে কব্জা করে নিয়েছে মোদী-অমিত শাহ জুটি।’
‘কাজেই সেই সব চ্যানেলের স্পনসর্ড পোল যে কী বলবে সেটা তো আন্দাজ করা মোটেই কঠিন নয়। তবে বিজেপি তিনদিন আনন্দ করে নিক তাতে আমাদের আপত্তি নেই – ২৩ তারিখ ফল বেরোনোর পর মোদী কীভাবে গরিষ্ঠতা পান সেটা না-হয় সবাই দেখে নেবেন’, বলছেন পবন খেড়া।
কংগ্রেস নেতারা একান্ত আলোচনায় আরও বলছেন, ‘কর্নাটকই যেমন দেখুন না। বেশির ভাগ এক্সিট পোল ওই রাজ্যের ২৮টা আসনের মধ্যে ২১ থেকে ২৫টা আসন বিজেপিকে দিচ্ছে। অথচ সেখানে কংগ্রেস আর জনতা দল (এস) এবারে জোট গড়ে লড়ছে – আমাদের আসন কিছুতেই অতটা কম হতে পারে না!’
কংগ্রেস ও বিজেপির বাইরে ভারতীয় রাজনীতির যে তৃতীয় শিবির বা ফেডারেল ফ্রন্ট, সেখানেও এই এক্সিট পোলের প্রতিক্রিয়া হয়েছে তীব্র।
এক্সিট পোলের রায়কে সরাসরি খারিজ করে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি যেমন রবিবার সন্ধ্যায় ঘোষণা করেছেন, ‘এই লড়াই আমরা একসঙ্গে লড়ব!’
এক্সিট পোল নিয়ে ব্যঙ্গ মিশিয়ে মজাদার টুইট করেছেন ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ও জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ।
তিনি বলছেন, ‘সব এক্সিট পোল তো আর ভুল হতে পারে না। তার চেয়ে বরং টেলিভিশন সুইচ অফ করে দিন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে লগ আউট করুন আর অপেক্ষা করে দেখতে থাকুন, ২৩ তারিখেও পৃথিবী নিজের কক্ষপথে ঘুরতে থাকে কি না!’
বস্তুত গত প্রায় দুমাস ধরে চলা নির্বাচনি প্রক্রিয়া ভারতকে যেভাবে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করে দিয়েছে, এদিনের এক্সিট পোল যেন ছিল সেই কফিনেরই শেষ পেরেক।
এর আর কোনও গুরুত্ব থাক বা না-থাক, আগামী তিনদিন ধরে তা নানা রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের খোরাক জোগাবে – আর ২৩ তারিখে আসল ফলাফলের পর সবাই অবধারিতভাবে এর কথা ভুলেও যাবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন