শ্রীলঙ্কার গির্জা ও হোটেলে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত ৯ সন্দেহভাজনের মধ্যে আটজনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে লঙ্কান পুলিশ জানিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন নারী। হামলাকারী এই তরুণ-তরুণীরা সবাই শ্রীলঙ্কার নাগরিক। তারা শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। হামলাকারীদের মধ্যে সহোদর দুই মুসলিম ভাইও রয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে।
অন্যদিকে রবিবারের ওই বোমা হামলায় আহত আরো ৩৮ জন মারা গেছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ৩৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে। হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গতকাল বুধবার আরো ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে মোট ৫৮ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হলো, যাদের মধ্যে দুই সহোদরের বাবাও রয়েছেন।
এই ঘটনায় শ্রীলঙ্কার দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যর্থতার প্রশ্ন উঠেছে। এ অবস্থায় নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গতকাল প্রেসিডেন্ট মাইত্রিপালা সিরিসেনা প্রতিরক্ষাসচিব ও আইজিপিকে অপসারণ করেছেন। শ্রীলঙ্কার মুসলিমসমাজের পক্ষ থেকে এই হামলায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে।
হামলাকারীরা শনাক্ত : গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে লঙ্কান উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী রুয়ান বিজয়বর্ধনে জানান, হামলাকারীদের মধ্যে আটজনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তাদের একজন নারী। তারা সবাই শ্রীলঙ্কার নাগরিক।
উপমন্ত্রী জানান, হামলাকারীদের একজন যুক্তরাজ্যে পড়ালেখা করেছিল। পরে সে অস্ট্রেলিয়ায় পোস্টগ্র্যাজুয়েট শেষে শ্রীলঙ্কায় ফিরে আসে। তিনি বলেন, অধিকাংশ হামলাকারী সুশিক্ষিত। তারা মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তারা আর্থিকভাবে যথেষ্ট সচ্ছল। তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাও বেশ ভালো।
এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে সাংবাদিকদের বলেন, হামলার সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে মঙ্গলবার হামলার দায় স্বীকার করে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কার পুলিশ জানিয়েছে, তারা মনে করে হামলাকারী স্থানীয় একটি অপরিচিত গোষ্ঠী, যাদের সঙ্গে বিদেশি যোগসূত্র থাকতে পারে। পুলিশ এই যোগসূত্র খতিয়ে দেখছে।
পুলিশের একটি সূত্র এএফপিকে জানিয়েছে, হামলায় দুই মুসলিম সহোদর জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। আত্মঘাতী এই দুই ভাই রাজধানী কলম্বোর ধনাঢ্য এক মসলা ব্যবসায়ীর ছেলে। তারা শেংরি-লা ও সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে হামলা চালিয়ে নিজেদের উড়িয়ে দেয়। এরই মধ্যে তাদের বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫৯ : রবিবার মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এই হামলায় অন্তত ৫০০ জন আহত হয়েছে। গতকাল পুলিশের মুখপাত্র রুয়ান গুনাসেকারা এ তথ্য জানান।
সন্দেহভাজনদের ধরতে অভিযান চলছে : রুয়ান গুনাসেকারা জানান, হামলায় জড়িত সন্দেহে আরো ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জরুরি অবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে মঙ্গলবার রাতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি জানান, জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলেন, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তিনটি ঠিকানায় অভিযান চালিয়ে ১৭ জনকে এবং আরেকটি পৃথক স্থান থেকে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আরো সন্দেহভাজন ধরতে অভিযান চলছে।
এ বিষয়ে উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী রুয়ান বিজয়বর্ধনে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত রবিবার হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার আরো হামলার আশঙ্কা করছে।
দুই ঘণ্টা আগেও সতর্ক করেছিল ভারত : ভয়াবহ এই আত্মঘাতী বোমা হামলার অন্তত দুই ঘণ্টা আগেও শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দা সংস্থাকে সতর্ক করেছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা। ভারত সরকারের এক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এনডিটিভি জানায়, হামলার ব্যাপারে শ্রীলঙ্কাকে প্রথমে ৪ এপ্রিল সতর্ক করেছিল ভারতের গোয়েন্দারা। পরে রবিবারের হামলার দুই ঘণ্টা আগে আবারও সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু এ সতর্কতা কাজে দেয়নি।
প্রতিরক্ষাসচিব ও পুলিশ প্রধান অপসারিত : শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইত্রিপালা সিরিসেনা গতকাল বিকেলে দেশটির প্রতিরক্ষাসচিব ও পুলিশ প্রধানকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। হামলা ঠেকাতে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যর্থতার জন্য তাঁদের অপসারণ করা হয় বলে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। গতকাল সিরিসেনার প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে কাদের তাঁদের স্থলাভিষিক্ত করা হচ্ছে তা তাত্ক্ষণিকভাবে জানানো হয়নি। এর আগে গত মঙ্গলবার সিরিসেনা টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিরাপত্তাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনবেন।
জড়িতদের বিচারে মুসলিম সিভিল সোসাইটির আহ্বান : শ্রীলঙ্কার মুসলিম নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। এক যৌথ বিবৃতিতে গতকাল এ আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ন্যাশনাল তৌহিদ জামাত হোক বা যেই হামলা চালিয়ে থাকুক, হামলাকারীরা ইসলামকে ধারণ করে না। তাদের মধ্যে মুসলিম বিশ্বাসের প্রতিফলন নেই। তারা ইসলামের অপব্যবহার করেছে এবং ইসলামবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। তাদের পরিচয় তারা অপরাধী। বিবৃতিদাতা সংগঠনগুলো হচ্ছে অল সিলোন জামায়াতুল উলেমা, মুসলিম কাউন্সিল, জামায়াতে ইসলামী, দ্য মেমন অ্যাসোসিয়েশন অব শ্রীলঙ্কা ও আঞ্জুমান-ই-সাইফি।
আগাম তথ্যের কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের : কলম্বোতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যালাইনা টেপলিত্জ গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, হামলার ব্যাপারে তাঁদের কাছে কোনো আগাম তথ্য ছিল না। তিনি বলেন, এটা পরিষ্কার যে নিরাপত্তা পদ্ধতিতে ব্যর্থতা ছিল।
নিউজিল্যান্ডের ভিন্ন বক্তব্য : শ্রীলঙ্কার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা প্রাথমিকভাবে মনে করছে এই হামলা নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুই মসজিদে চালানো হামলার প্রতিশোধ। তবে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, এই দাবির পক্ষে কোনো গোয়েন্দা তথ্য তাঁদের কাছে নেই। এমনকি এ ধরনের কোনো তথ্য তাঁরা শ্রীলঙ্কা থেকেও পাননি।
সূত্র : এএফপি, এপি, এনডিটিভি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন