ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে নৃশংস সে হামলার পর হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। হত্যাযজ্ঞের আলামত আর ছবি দেখতে দেখতে হতাশ হয়ে পড়া মানুষেরা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এক খণ্ড আশার প্রতিচ্ছবি। আর তারা তা খুঁজে পেয়েছিলেন নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নের একটি ছবিতে। হামলার একদিন পর তোলা ওই ছবিতে দেখা গেছে, জাসিন্ডা কালো ওড়নায় মাথা ঢেকে আছেন আর জানালার গ্লাসের বাইরে থেকে বিভিন্ন রঙের ফুলের প্রতিফলনে ভরে গেছেন তিনি। হাতের ওপর হাত জড়ো করে ক্রাইস্টচার্চের মুসলিম কমিউনিটির কথা শুনছিলেন নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। মনযোগ আর দরদ এ দুইয়ের মিশ্রণ ঘটেছিলো তার চেহারায়। দেশটির ইতিহাসের ‘অন্ধকারতম দিনেও’ জাসিন্ডার সে চেহারা দেখে আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল মানুষ। আর ছবিতে বিভিন্ন রঙের ফুলের প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিলো নিউ জিল্যান্ডের বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সম্মিলনের কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে ওই ছবি পৌঁছে গিয়েছিল বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের কাছে।
জাসিন্ডা আরডার্ন
১৫ মার্চের হামলার একদিন পর ১৭ মার্চ দুপুরের দিকে ফিলিপসটাউন কমিউনিটি সেন্টারে ছবিটি তুলেছিলেন, ক্রাইস্টচার্চ সিটি কাউন্সিলের ফটোগ্রাফার কির্ক হারগ্রিভস। তবে সে ছবি তোলার কাজটি এতো সহজসাধ্য ছিল না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই ছবি তোলার নেপথ্যের ঘটনা বর্ণনা করেছেন ফটোগ্রাফার হারগ্রিভস।
১৭ মার্চ মুসলিম কমিউনিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করতে জাসিন্ডা আরডার্ন অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা ও ওয়েলিংটনের সংবাদকর্মীদেরকে নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ শহরে পৌঁছান। ছোট একটি শ্রেণিকক্ষে জড়ো হন তারা। দ্য প্রেসের সাবেক ফটোগ্রাফার হারগ্রিভস-এর সেখানে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। তিনি ভেতরে ঢুকতে পারলেন না। অবশেষে বাইরে থেকেই ছবি তোলার সিদ্ধান্ত নেন। হারগ্রিভস জানালার গ্লাসের মধ্য দিয়েই ছবি তোলার চেষ্টা করেন। তবে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হওয়ার কারণে তিনি কিছু দেখতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে আরডার্ন বসা থেকে উঠে দাঁড়ান। আর তখন বাইরে থেকে আরডার্নের মুখ দেখতে পান হারগ্রিভস।
“সত্যিকার অর্থে আমি শুরুতে তার ছবি তুলতে পারছিলাম না, কারণ সেখানে অনেক আলোর প্রতিফলন ছিল। সেকারণে আমি ক্যামেরায় ফিল্টার লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। একে বলা হয় পোলারাইজিং ফিল্টার। কিন্তু তা কাজ করলো না। আমি নিজেকে নিজে বলতে লাগলাম, ‘আরে নিষ্কর্মা, কিছু হবে না’। তবে একটু পরই আমি ছবি তোলার জন্য এ অ্যাঙ্গেলটি পেয়ে গেলাম। এরপর আমি তার (জাসিন্ডা) বডি ল্যাংগুয়েজ, বাইরে থেকে গ্লাসের ওপর পড়া ফুল আর গাছের প্রতিফলনকে একত্রিত করে অবিশ্বাস্য এ কাজটি সম্পাদন করলাম। তার অসাধারণ বডি ল্যাংগুয়েজ আর বাকি সব কিছু মিলে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মিশ্রণের প্রতিকী রূপ প্রকাশ করছিলো। আর এ ছবিটাই ক্যামেরায় ধারণ করার অপেক্ষায় ছিলাম আমি।”
ক্রাইস্টচার্চ সিটি কাউন্সিলের ফেসবুক পেজে ছবিটি প্রকাশ করা হলো এবং তা ক্রমাগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো। জাসিন্ডা আরডার্নের নেতৃত্বকে বর্ণনাকারী এক ছবিতে পরিণত হলো এটি।
হারগ্রিভসের তোলা জাসিন্ডার পুরো ছবি
হারগ্রিভসের তোলা জাসিন্ডার পুরো ছবি
হারগ্রিভস মনে করেন, ক্রাইস্টচার্চ শহর যখন ইতিহাসের বর্ণহীন, হতাশাপূর্ণ এক সময় পার করছে, তখন জাসিন্ডা আরডার্নের ওই ছবিটি আশার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
‘মানবতার তাড়না থেকে আমি ছবিটি তুলেছিলাম। আমিও জানতাম না এ ছবি এতোটা জনপ্রিয়তা পাবে। তবে ফটোগ্রাফার হিসেবে আমি বুঝেছিলাম, এটি হঠাৎ পাওয়া একটি শট। তিনি (জাসিন্ডা) কী করছেন, কিভাবে মানুষের কাছে মানবিকতাপূর্ণ অনুভূতিটুকু পৌঁছে দিচ্ছেন এবং তাদের কথা শুনছেন, উদ্বিগ্ন হচ্ছেন, ভালোবাসা জানাচ্ছেন- তার সব কিছুই এ ছবির মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে।’ বলেন হারগ্রিভস।
হারগ্রিভস মনে করেন, যেকোনও ধর্ম ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই ছবিটি নিয়ে যাওয়া হোক না কেন, এটিকে একইভাবে বর্ণনা করা হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন