কেবল ইসলাম কিংবা খ্রিষ্ট ধর্মের জন্য নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে ক্রুসেড একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ‘ক্রুসেড’ শব্দটি দ্বারা মূলত ধর্মীয় যুদ্ধ বোঝানো হয়। সাধারণ ভাবে বিশ্ব ইতিহাসে ক্রুসেড বলতে পবিত্র ভূমি অর্থাৎ জেরুজালেম এবং কন্সাটান্টিনোপল এর অধিকার নেয়ার জন্য ইউরোপের খ্রিস্টানের সম্মিলিত শক্তি মুসলমানদের ১০৯৫ – ১২৯১ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার যে যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করে সেগুলোকে বোঝায়।
ক্রুসেডের সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ঠিক কোন যুদ্ধ বা অভিযানগুলোকে ক্রুসেড বলা হবে তার ব্যাপারেও নানা মত। আসলে পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স বাইজেন্টাইন সম্রাট এই যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন আনাতোলিয়াতে মুসলমান সেলজুক সম্রাজ্যের বিস্তার রোধ করার জন্য। ক্রুসেডের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমনঃ জেরুজালেম দখল করা, খ্রিষ্টানদের এলাকা পুনরায় দখল করা, খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা রক্ষা করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ইত্যাদি।
পোপ দ্বিতীয় উর্বানের দ্বারা প্রথম ক্রুসেডের সূত্রপাত হয়। তিনি ১০৯৫ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাজ্য হতে সহায়তা চান। প্রথমে ক্রুসেড বলতে মুসলমানদের কাছ থেকে জেরুজালেম শহর ফিরিয়ে নেওয়ার ইউরোপীয় প্রচেষ্টাকে বোঝানো হত। পরবর্তীতে অ-খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের যেকোন সামরিক প্রচেষ্টাকে ক্রুসেড বলা শুরু হয়।
অন্যভাবে দেখলে, ক্রুসেডারেরা মূলত মধ্যপ্রাচ্যে সামন্তবাদী রাজ্য স্থাপনে সমর্থ হয়েছিল। তাই ক্রুসেডগুলিকে ইউরোপীয় সম্প্রসারণবাদ ও উপনিবেশবাদের একটি আদি রূপ হিসেবে উল্লেখ করেন অনেকে। এভাবেই প্রথমবারের মত ইউরোপীয় খ্রিস্টানেরা দেশ থেকে বহুদূরে সামরিক অভিযানে বের হওয়া শুরু করে এবং তাদের সংস্কৃতি ও ধর্ম বিদেশে বিস্তৃত করার চেষ্টা চালায়।
ক্রুসেডগুলো যুদ্ধভিত্তিক খ্রিষ্টধর্ম এবং ইউরোপের খ্রিষ্টান মতবাদ সম্প্রসারণের বহিঃপ্রকাশ। তবে, এগুলিতে ধর্মীয় চেতনার সাথে ধর্মনিরপেক্ষ সামরিক চিন্তাধারার মিলন ঘটেছিল।
ক্রুসেডের কারণ
পোপ ২য় উর্বানের ভাষণে ক্রুসেডের বীজ বপিত হয়েছিল সর্বপ্রথম। তিনি সেলজুক তুর্কিদের বিরুদ্ধে বাইজেন্টীয় সম্রাট আলেক্সির সাহায্য চেয়ে পাঠান এবং ফিলিস্তিনে খ্রিষ্টান তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। পোপ উর্বান তাঁর ভাষণে খ্রিষ্টানদের প্রাচীন বিভিন্ন ঐতিহ্যের কথা বলেন যেমন স্পেনের মুসলিম শাসকদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
ফ্রাংক জাতির রাজা ছিলেন শার্লমাঞ্চ। ৮১৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এরপর খ্রিষ্টান ভাবধারার ইউরোপ, আক্রমণের সম্মুখীন হয়। এশিয়া থেকে মজর নামের যাযাবর জাতিরা এসে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে লুটতরাজ আরম্ভ করে এবং ১০ম শতক পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখে। অষ্টম শতাব্দী থেকে উত্তর ইউরোপে ভাইকিংয়েরা দস্যুগিরি শুরু করে। পাশাপাশি তারা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেও হানা দিয়েছিলো।
এ ছাড়াও এ সময়ে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায় ইসলামের প্রসার। ৮ম শতকের মধ্যেই ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীর, উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেনের অধিকাংশ অঞ্চল ইসলামি শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তারা ইতালিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে, গ্রিকদের চিরায়ত সংস্কৃতির ধারক বাইজেন্টীয় সাম্রাজ্যের ক্ষমতা খর্ব করে এবং সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সতান্তিনোপল অবরোধ করে। ভাইকিং বা মজর জাতির তুলনায় ইসলামের হুমকি ছিল দ্বিমুখী; এটি ছিল সংস্কৃতি ও ধর্ম উভয়ের যুদ্ধ।
ক্রুসেডের ইতিহাস অনেক বিস্তৃত এবং জটিল ইতিহাস। ক্রুসেড নিয়ে নানা সময়ে অনেকে লিখেছেন। ইসলামী বিশ্বে সালাউদ্দিন আইয়ুবি এবং ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ডের মধ্যে সংঘটিত ক্রুসেড নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন