ইসলামিস্ট, জিহাদিস্ট, আই.এস.আই.এস, সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা, বোরকা, ৯/১১...
ইত্যাদি তকমা... তকমা শুধুমাত্র একটি শব্দকে দেয়া হয়েছে যার অর্থ ‘সৃষ্টিকর্তার প্রতি শান্তিপূর্ণ সমর্পণ’। ইসলাম এমন একটি ধর্ম যার সাথে অনেক নেতিবাচক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে এবং গণমাধ্যমসমূহ একে সমস্ত ভুল কারণের উৎস হিসেবে চিত্রায়িত করে।
সুতরাং, কেন একজন উচ্চ শিক্ষিত, স্বাধীন এবং ভ্রমণ প্রিয় অস্ট্রেলিয়ান নারী ইসলাম সম্পর্কে এতকিছু জেনেও এই ধর্ম গ্রহণ করেছেন?
আমি আমার শ্বেত গায়ের রং এবং আলোক উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে পড়ি। কিছু অস্ট্রেলিয়ান আমি কোন দেশ থেকে এসেছি তা জানতে চায়, এবং তারাও অবাক হয়ে পড়ে যখন শুনতে পায়ে যে, আমি একজন অস্ট্রেলিয়ান।
অস্ট্রেলিয়ান এবং মুসলিম? এ দুটোর একসাথে হওয়া দেখে অনেকের কাছেই তা অচিন্তনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা অতোটা সহজ ছিল না। আমাকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছিল, সতর্ক করা হয়েছিল, বাদ দেয়া হয়েছিল এমনকি চাকরীচ্যুত করা হয়েছিল। আমি আমার বন্ধু-বান্ধব হারিয়েছি এবং আমার পরিবারের সাথে অনেক কষ্টকর সময় কাটিয়েছি।
আমার বিশ্বাসের পরিবর্তন নিয়ে আমি অনেক বাজে মন্তব্য শুনেছি, অনেকে আমাকে এও বলেছে যে, আমি একজন পুরুষের জন্যই ধর্মান্তরিত হয়েছি। এদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে জানতে চেয়েছে কেন আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি।
আর এটি এমন একটি প্রশ্ন যার উত্তর দিতে আমি সুখী অনুভব করি। আমার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পেছনে তিনটি প্রধান কারণ ছিল। আর এটিই আমার গল্প যা আমাকে দুই বছর পরে বর্তমানে এসে দাঁড় করিয়েছে।
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়া ভ্রমণ আমার ইসলাম গ্রহণের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। মালয়েশিয়া আসার পূর্বে আমি ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। এর পূর্বে কোনো মুসলিমের সাথে আমার সাক্ষাতও ঘটে নি আর আমি মুসলিম বলতে লম্ব আলখাল্লা পরিহিত আরবদেরকে বুঝতাম।
আমি মনে করতাম মুসলিম নারীরা বৈষম্যের শিকার এবং তারা তাদের স্বামীদের অনুমতি ছাড়া ঘরের বাহির হতে পারে না।
মালয়েশিয়া ভ্রমণের পরে আমি দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম নারীদের সম্পর্কে এবং তাদের রং বেরঙের হিজাব সম্পর্কে জানতে কৌতূহলী হয়ে উঠি।
এখানে এসে আমার মন খুলে যায় এবং ইসলামে নারীদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পেরে আমি আমি চমৎকৃত হয়ে পড়ি।
মুসলিম নারীদের রয়েছে, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, ভূমির অধিকার, অর্থের অধিকার, বিবাহ করার অধিকার ইত্যাদি যেগুলো পবিত্র কুরআন এবং হাদিস তাদের দিয়েছে আর পশ্চিমের নারীরা এইসমস্ত অধিকার লাভ করেছে মাত্র কয়েকশ বছর পূর্বে।
মালয়েশিয়াতে আমি যখন প্রথম কোনো মসজিদে সফর করি তখন আমি নীরবতা এবং শান্তি অনুভব করি। যখন আমি কাবার দিকে তাকিয়ে প্রথম মাথা নিচু করি, তখন আমি আমার হৃদয়কে নিজের বাড়ি হিসেবে অনুভব করতে থাকি।
খ্রিষ্টান ধর্ম
আমি ছিলাম একজন গোঁড়া খ্রিষ্টান যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ইসলাম গ্রহণের পেছনে মূলত আমার খ্রিষ্টান ধর্মটিই বেশি কাজ করেছে। যিশুর জন্য আমার ভালোবাসা আমাকে ইসলামের দিকে ধাবিত করেছে।
খ্রিষ্টান ধর্মটির সাথে ইসলামের অনেক মিল রয়েছে এবং তা শুধুমাত্র তাত্ত্বিক দিক থেকেই নয় বরং ঐতিহাসিক দিক থেকেও। ইসলাম ধর্ম খ্রিষ্টানদের সম্পর্কে ঠিক কি বলে তা নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে।
খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদেরকে ইসলাম ধর্ম ‘কিতাব ধারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে, কারণ আমাদের সকলেরই মূল এসেছে ইব্রাহিম(আ.) থেকে। আর পবিত্র কুরআনে নবী যিশু(আ.) এর নাম নবী মুহাম্মদ(সা.) এর নামের চাইতে বেশী উল্লেখ করা আছে।
মুসলিমগণ এখনো বিশ্বাস করে যে, যিশু কুমারী মাতা মেরির গর্ভে আল্লাহর ইচ্ছায় জন্ম গ্রহণ করেছেন। ইসলামে যিশু একজন গুরুত্বপূর্ণ নবী এবং যিশুকে বিশ্বাস করা ছাড়া আপনি পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হতে পারবেন না।
সাংবাদিকতা
সাংবাদিকতার জন্য আমার আগ্রহ আমাকে এমন সব স্থানে নিয়ে এসেছে যা আমি কখনো কল্পনাও করতে পারি নি এবং এটি আমাকে অনেক বিস্ময়কর মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমি অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি।
তরুণ বয়সেই এমন সব দারুণ অভিজ্ঞতা নেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে যখন আমি আমার সাংবাদিকতা পাঠ শেষ করিনি। আর সাংবাদিকতাই আমাকে ইসলামের কাছে পৌঁছিয়েছে। হ্যাঁ, আমি এখনো সাংবাদিকতা করি এবং এখনো আমি একজন উৎসাহী মুসলিম নারী।
জাতিসংঘের ‘বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব’, আবেগপূর্ণ নেতৃত্ব, সিস্টার ইন ইসলাম, লেখিকা এবং নারী অধিকারের অন্যতম প্রবক্তা মারিনা মাহাথিরের সাক্ষাতকার নেয়া আমার জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
এই সাক্ষাৎকার অবশ্যই মুসলিম নারী এবং ইসলাম সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দিয়েছে। মারিনা মাহাথিরের সাক্ষাৎকারটি ছিল আমার প্রথম কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির নেয়া সাক্ষাৎকার। আমি মারিনার সাথে সাক্ষাত করার সময় তার শান্ত এবং ব্যক্তিত্ব পূর্ণ প্রকৃতি আমাকে অভিভূত করে দেয়।
আমি জানতাম সেই সাক্ষাতকারটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যা আমার জীবনে পরিবর্তন নিয়ে আনবে। তিনি আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। পবিত্র কুরআন বৈষম্যের শিক্ষা দেয় না। এটি পুরুষদেরকে তাদের স্ত্রীদের প্রহার করার অনুমোদন দেয় না। মারিনা মাহাথির অসাধারণ জ্ঞানী ছিলেন।
একজন সাংবাদিকের চারপাশে ঘটে যাওয়া বিষয় সমূহ লোকজনদের অবগত করানোর মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সমাজে তাদের ভূমিকা রাখতে হয়। আর আমি ইসলামে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি শিখেছি তা হচ্ছে, সকলকে খারাপভাবে বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ যেকেউ যে কোনো কিছু হতে পারে।
মুহাম্মদ(সা.) আমাদের বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় জিহাদ হচ্ছে নিজের কু প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।’ আমরা অন্যদের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মনের উন্নতি করতে পারি।
কিন্তু, একজন নতুন মুসলিম হয়ে তা নিজের জীবনের একমাত্র পাথেয় করাটা খুব সহজ কাজ ছিল না। এটি খুবই কঠিন ছিল এবং আপনি প্রতিদিনই নতুন কিছু শিখতে পারবেন। লোকজন আপনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে, এমনকি মুসলিমরাও আপনাকে বিচার করবে।
আমি শুধুমাত্র এসবের চারপাশে কিছু পবিত্র আলো ছড়িয়ে দিই। একজন মুসলিম হওয়ার পরে আমি এত বেশী ধৈর্যশীল হয়ে পড়ি যা আমি কল্পনাও করতে পারি নি।
আর শেষে আমি বলতে চাই যে, আমি আল্লাহ তায়ালার প্রতি নিজেকে সমর্পণ করে শান্তি খুঁজে পাই এবং আমি কিভাবে চলছি তা গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং প্রত্যেকবার আমার সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করার সময় আমার মনে হয়ে, আমি এ পৃথিবীতে একা নই। পবিত্র কুরআন ঘোষণা করেছে- ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক কষ্টের পরে স্বস্তি রয়েছে।’- আল-কুরআন, সুরা আলাম-নাশরাহ, আয়াত-৬।
সূত্র: এবাউটইসলাম ডট নেট।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন