উইঘুরের নির্যাতনকে বৈধতা দিয়ে চীন কী পেতে চাইছে
আহমেদ শরীফ ২:১৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৫, ২০১৮
Share
উইঘুরের নির্যাতনকে বৈধতা দিয়ে চীন কী পেতে চাইছে
গত ৯ই অক্টোবর চীন সরকার তার পশ্চিম সীমান্তের মুসলিম-অধ্যুষিত উইঘুর বা শিনজিয়াং প্রদেশের জন্যে ‘উগ্রবাদ-বিরোধী আইন’ সংশোধন করে। ‘শিনজিয়াং উইঘুর অটোনমাস রিজিয়ন রেগুলেশন অন এন্টি-টেরোরিজম’ নামের আইনে কিছু পরিবর্তন আনা হয়, যাতে করে সেই প্রদেশের সরকার সেখানে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে জনগণকে ‘পূণঃ-শিক্ষা’ দিতে পারে। সেখানে বলা হয় যে কাউন্টির সমকক্ষ কর্তৃপক্ষ এখন মানুষকে শিক্ষা দেবার এবং তাদের আচার-ব্যবহার পরিবর্তন করার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো সুপারভাইজিং ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। চীন সরকার বলছে যে, এটা তারা করছে ধর্মীয় উগ্রবাদিতাকে বন্ধ করার লক্ষ্যে।
‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এই আইনের অধীনে স্থাপিত প্রতিষ্ঠান চীনা ভাষা শিক্ষা দেয়া ছাড়াও আইন বিষয়ে শিক্ষা দেবে। তারা একইসাথে ‘আদর্শিক শিক্ষা’, মানসিক চিকিৎসা, এবং আচরণ পরিবর্তনের কাজ করবে, যাতে তারা ‘সমাজ এবং পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারে’। তবে চীনা সরকার এই পরিকল্পনাগুলি আইন পাস করার এক বছর আগে থেকেই করে আসছিল। এখন আইন পাসের মাধ্যমে সেই কাজটাকেই নতুন করে কাগজপত্রের বৈধতা দেয়া হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলি বলছে যে, চীনা সরকার উইঘুরে হাজার হাজার মানুষকে জোর করে আটকে রেখে ‘পূণঃ-শিক্ষা’ দিচ্ছে।
পরিবর্তিত এই আইনের শুরু ২০১৭-এর মার্চে। সেসময় এই আইনের অধীনে বিভিন্ন মুসলিম রীতিনীতির উপরে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়; যেমন – দাড়ি রাখা, মহিলাদের হিজাব পড়া, রেডিও-টেলিভিশন না দেখা, শিশুদের চীনা জাতীয় শিক্ষা না দেয়া, ইত্যাদি।
এই আইনের মাধ্যমে চীন আসলে কি পেতে চাইছে? গত আগস্টে জাতিসংঘের এক প্যানেল চীনা কর্মকর্তাদের বলে যে, চীন তার নিজস্ব আইনের বাইরে গিয়ে উইঘুরের নাগরিকদের আটকে রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপও তা-ই বলছে। এই আইনের পর এখন চীন সরকার অন্ততঃ এটা বলতে পারবে যে, তারা আইন বহির্ভূত কোনো কাজ করছে না। মেলবোর্নের লা ট্রোব ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জেমস লাইবোল্ড-এর মতে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তাদের কর্মকাণ্ডকে আইনগত এবং রাজনৈতিক বৈধতা দিতে ব্যস্ত রয়েছে। এর আগের ২০১৭ সালের আইন উইঘুরের মানুষকে শিক্ষা দেবার ব্যাপারে খুব বেশি নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। এখন কাজ করে ফেলার পর আইন পরিবর্তন করে এটা বোঝানো হচ্ছে উইঘুরে বহু মানুষকে আটকে রাখার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে।
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলি বলছে যে, আইন পাস করলেই এই কর্মকাণ্ডগুলিকে যুক্তিযুক্ত করা যায় না। ‘সেফগার্ড ডিফেন্ডার্স’ নামের এক সংস্থায় কর্মরত মানবাধিকার কর্মী মাইকেল ক্যাস্টার বলছেন যে, এটা হলো বেইজিং-এর মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ‘আইনের শাসন’এর কথা বলে ধামাচাপা দেয়ার আরেকটা চেষ্টা। উইঘুরে যা হচ্ছে, তা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের কাতারেও পড়তে পারে।
চীনা সরকার বলছে যে, উইঘুরের সমস্যার মূলে রয়েছে সেখানকার ইসলামী জঙ্গীবাদ আর বিচ্ছন্নতাবাদীরা। শিনজিয়াং প্রদেশকে পশ্চিমারা চীনের অংশ হিসেবেই স্বীকার করে। এখানকার বাসিন্দারা মূলতঃ মুসলিম হলেও সাম্প্রতিককালে চীনা সরকারের নীতির কারণে এখানকার জনসংখ্যায় বিরাট পরিবর্তন এসেছে। উইঘুরে ইসলামের আবির্ভাব হয় ৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দের দিকে কারা-খানিদ রাজত্বের সময়ে। উইঘুরের রাজধানী কাশগার বেশ দ্রুতই ইসলামিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। সেসময়কার উইঘুরের আলেমদের লেখা বই বাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়িয়েছিল। একইসাথে উইঘুর ছিল চীনের সাথে পশ্চিমের মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাগুলির সংযোগস্থল। ১৮৭৬ সালে চীনের মাঞ্চু রাজ্য উইঘুরদের রাজ্য আক্রমণ করে, যে রাজ্য তখন পর্যন্ত ‘পূর্ব তুর্কিস্তান’ নামে পরিচিত ছিল। মাঞ্চু রাজারাই আট বছর যুদ্ধের পরে ১৮৮৪ সালের নভেম্বরে এই রাজ্যের নামকরণ করেন ‘শিনজিয়াং’, যার অর্থ ‘নতুন সীমানা’। প্রায় ইরানের সমান আয়তনের উইঘুর রাজ্য কাজাখস্তান, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান-সহ বেশকিছু মুসলিম অঞ্চলের কাছাকাছি। ১৯১১ সালে চীনের জাতীয়তাবাদীরা মাঞ্চু রাজদের হাত থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিলে উইঘুরও চীনা জাতীয়তাবাদীদের হাতে চলে যায়। সেসময় থেকেই উইঘুরের জনগণ চীন থেকে আলাদা হবার চেষ্টা করছে। ১৯৩৩ সালে এবং ১৯৪৪ সালে দু’দুবার উইঘুরের জনগণ স্বাধীন ‘পূর্ব তুর্কিস্তান’ রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়।
তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হাতে ক্ষমতা যাবার পর থেকে উইঘুরের ইতিহাস নতুন দিকে মোড় নেয়। কমিউনিস্টরা চীনের পূর্বাঞ্চলের জাতিগত ‘হান’ জনগোষ্ঠিকে উইঘুরে নিয়ে বসতি স্থাপনে মনোযোগী হয়। এর ফলে যেখানে ১৯৪৭ সালে উইঘুরে হান জনগণ ছিল ৫ শতাংশ, সেখানে ২০০০ সালে তা দাঁড়ায় ৪০ শতাংশে। ২০১০ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী শিনজিয়াং-এর ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ উইঘুর জনগণ, আর ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ হান জনগণ; বাকিটা কাজাখ, হুই এবং অন্যান্য জাতি। চীনা সরকারি নিয়মে উইঘুর হলো তিব্বতের মতোই একটা স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য।
২০০৯ সালে উইঘুরে হান এবং উইঘুরদের মাঝে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়। এরপর থেকে চীন সরকার সেখানকার মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপরে ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করে। সাম্প্রতিককালে উইঘুরের মুসলিমদের ইসলাম পালনে বাধা দেবার অনেক রিপোর্ট পাওয়া যায়। ছাত্র, শিক্ষক এবং সরকারি চাকুরিজীবিদের রমজান মাসে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করার অনেকগুলি আলাদা আলাদা খবর পাওয়া যায়। ২০১৭ সালের মার্চের আইনে সরকারী কর্মকর্তাদেরকে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এবং অনান্য জনসমাগমের স্থানে মহিলাদের হিজাব বা বোরখা পরিহিত অবস্থায় যেতে বাধা দেবার কথা বলা হয়; দরকার হলে পুলিশে খবর দিতে বলা হয়। এমনকি দাড়ি কতটুকু লম্বা রাখতে পারবে, তা-ও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়; এবং শিশুদের ইসলামিক নাম রাখার উপরে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে বিয়ে করার উপরেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে এই আইনে। এই সবগুলি আইনই চীন সরকারের ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টার সাথে সম্পর্কিত।
উইঘুরের মুসলিমদের উপরে অত্যাচারের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে চীন তার ভাবমূর্তি হারাবার অবস্থায় পড়লেও সেটা যে এই মুহুর্তে চীন সরকারের কাছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠার সাথে একাত্মতা প্রকাশের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা বোঝা যায়, যদিও চীনের বেশিরভাগ জ্বালানি তেলের উৎসই মুসলিম বিশ্বে।
লেখক: ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন