ইসলামের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ বার্নার্ড লুইস শনিবার (১৯ মে) আমেরিকার নিউ জার্সির ভোরহেস টাউনশিপে মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০১ বছর।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপকের দীর্ঘমেয়াদী সহযোগী বুটজি চার্চিল তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একজন বিখ্যাত মানুষ। যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যার মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তিনি কেবল লেখালেখিই করেন তা নয়, পশ্চিমের বিদগ্ধ সমাজে তাকে নেতৃস্থানীয় ইতিহাসবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। তার ‘ইসলামি সভ্যতা পতন’ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি যা বিশ্ব মতামতকে প্রভাবিত করেছে এবং প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের অধীনে আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতি গঠনে সাহায্য করেছিল।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে বার্নার্ড লুইস বুশ প্রশাসনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। এর আগে খুব কম বিদেশিই ও পণ্ডিতরা বুশ প্রশাসনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট বুশ তার ব্রিফিং পেপারে লুইসের একটি নিবন্ধের একটি চিহিৃত কপি রাখতেন এবং ২০০৩ সালের মার্চ মাসে ইরাকে আক্রমণের আগে এবং পরে তার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। লুইস তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি এবং পেন্টাগনের প্রতিরক্ষা সচিব ডোনাল্ড রামসফেল্ডকে নিয়ে হোয়াইট হাউসে ব্রিফিং করেছেন।
ইসলাম সম্পর্কে তার অপরিহার্য যুক্তি ছিল যে ইসলামিক সভ্যতা শত শত বছর ধরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। আন্তর্জাতিক পরিসরে সন্ত্রাসকে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে মুসলিমদের দীর্ঘমেয়াদী হতাশা শোষণের অবস্থান থেকে ওসামা বিন লাদেনের মত চরমপন্থীদের লালন করা হয়েছিল।
আরব সন্ত্রাসীরা বাণিজ্যিক বিমান অপহরণ করে সেটি দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র বিস্ফোরণ ঘটায় এবং পেন্টাগন বিন লাদেনের দ্বারা অনুমোদিত একটি সমন্বিত অভিযান পরিচালিত করে। সে সময়ে লুইসকে মার্কিন নীতি নির্ধারকদের পক্ষ থেকে তলব করা হয়েছিল।
তিনি বিন লাদেনের ধর্মীয় মৌলবাদে গুরুতর বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্কে সমালোচনা করেছিলেন। এটিকে তিনি আরব শাসকদের দমনমূলক শাসন এবং ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের ধর্মনিরপেক্ষ স্বৈরতন্ত্রের একটি প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই উভয় শাসনের জন্য গণতন্ত্র ছিল একমাত্র সমাধান। লুইস লিখেন, ‘আমরা তাদের স্বাধীনতা আনতে পারি নতুবা তারা আমাদের ধ্বংস করে।’
এই লুইস একবার ফরাসী পত্রিকা ‘লা মান্ডে’কে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে আর্মেনিয়ার গণহত্যা নিয়ে কিছু মন্তব্য করে বসেন। তিনি বলেন, আর্মেনিয়ায় যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে, সেটি গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে না। কাজেই সেখানে গণহত্যা হয়েছে, এমনটি বলা যাবে না। পশ্চিমের একজন শীর্ষ ইতিহাসবিদ, গবেষক হিসেবে লুইস তার গবেষণালব্ধ তথ্য দিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করতেই পারেন। কিন্তু তার এই বক্তব্য নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় আর্মেনিয়ানদের মধ্যে। সেই প্রতিক্রিয়ার সূত্র ধরে একটি ফরাসী আদালত তাকে এক ফ্রাঙ্ক জরিমানা করে।
ঘটনাটা ১৯৯৩ সালের নভেম্বর মাসের। ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান অধ্যাপক বার্নার্ড লুইস নানাভাবে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খোদ পশ্চিমের ইতিহাসবিদ-গবেষকরাও তার কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি। বরং তার মন্তব্যটি সেখানেও সমালোচিত হয়েছে।
বার্নার্ড লুইসের শাস্তি মাত্র এক ফ্রাঙ্ক জরিমানার মধ্যে সীমিত থাকলেও, ডেভিড আর্ভিংএর ভাগ্য অত প্রসন্ন ছিল না। পশ্চিমের খ্যাতনামা এই ইতিহাসবিদকে ১৩ মাস জেল খাটতে হয়েছে। তার অপরাধ ছিল, তিনি হলোকাস্ট অস্বীকার করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাজি বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল তাকে ঠিক ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করতে চাননি ইতিহাসের এই গবেষক। ভিয়েনার একটি আদালত তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। তের মাস জেল খাটার পর অবশ্য তিনি ছাড়া পান।
আর মার্কিন অধ্যাপক পিটার আর্লিন্ডারকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল রুয়ান্ডার একটি আদালত। আইনজীবী এবং আইনের এই অধ্যাপক খোদ জাতিসংঘে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক মামলায় আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘসময়। কিন্তু রুয়ান্ডার গণহত্যাকে তিনি ঠিক ‘গণহত্যা’ হিসেবে মানতে চাননি। তিনি বলে ফেলেছিলেন, ১৯৯৫ সালে ১.৫ মিলিয়ন অটোম্যানের হত্যাকাণ্ড ঠিক গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে না। এটি যুদ্ধের একটি বাই প্রোডাক্ট মাত্র।
এই মন্তব্যের কারণে রুয়ান্ডার আদালত তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অধ্যাপক আর্লিন্ডার তখন রুয়ান্ডায় গণহত্যা বিষয়ক মামলায় একটি পক্ষের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করছিলেন। কিন্তু বেফাঁস এই মন্তব্যের কারণে তাকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করতে হয়।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন