যুদ্ধ থেকে পালিয়ে সমুদ্র পথে যে সব শরণার্থী ইউরোপে ঢুকছেন তারা সৈকতে ফেলে যাচ্ছেন লাখ লাখ লাইফ জ্যাকেট। স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা এই লাইফ জ্যাকেট মনে করিয়ে দেয় তাদের কষ্টের কথা।
গ্রিসের সৈকত থেকে সেগুলো জড়ো করে সেলাই করে বানানো হচ্ছে নানা সামগ্রী। আর সেগুলো বানাচ্ছেন শরণার্থীরা নিজেরাই।
সেলাই মেশিন আর সিরিয়ান ভাষা এই দুইয়ে মিলে জমজমাট একটি কমিউনিটি সেন্টার। যেখানে বহু সিরিয়ান সেলাই মেশিন আর কাচি নিয়ে ব্যস্ত। এখানে এই শব্দ আর লাইফভেস্টগুলোর সাথে মিশে আছে সেই শরণার্থীদের গল্প যারা যুদ্ধের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন। যারা পালিয়ে আসতে গিয়ে সমুদ্রে প্রাণ হারিয়েছেন রয়েছে তাদের গল্পও।
কিন্তু একই সাথে শরণার্থীরা এখানে সেলাই মেশিনে বুনে চলেছেন নতুন জীবনের গল্প। হোমস শহরের শিক্ষক এলহাম শাহীন তাদের একজন।তিনি বলছেন, "আমি স্বেচ্ছাসেবকের কাজ পছন্দ করি। সিরিয়া থাকতে আমি নিয়মিত এরকম কাজ করতাম। কিন্তু এখানে আমি কিছু টাকা পাচ্ছি। প্রতি মাসে দেড় শ' ইউরো পাই। তাতে কিছুটা উপকার হচ্ছে।"
উজ্জ্বল কমলা রঙের লাইফ জ্যাকেটের কাপড় দিয়ে ব্যাজ বানাচ্ছিলেন শাহীন।
যার কাজ হলো, শরণার্থীদের সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।
তিনি বলছেন, "লাইফভেস্ট সম্পর্কে আমরা ধারণা বদলাতে চাইছি। এটি শুধু বিপদের কথা বলে। এখন এগুলো দিয়ে আমরা সচেতনতা বৃদ্ধি করবো। এগুলো এখন আমাদের জীবনের গতি পরিবর্তনে সহায়তা করবে।"
নেদারল্যান্ডসের সংস্থা মেকারস ইউনাইট সেই সুযোগ করে দিচ্ছে শরণার্থীদের। তাদের স্বেচ্ছাসেবকেরা গ্রিসের দ্বীপগুলোর সৈকত থেকে শরণার্থীদের ফেলে যাওয়া লাইফ জ্যাকেট সংগ্রহ করছেন। তার পর সেগুলো কেটে সেলাই করে নানা পণ্য তৈরি করা হচ্ছে।
যেমন ধরুন ল্যাপটপ কাভার, কাগজপত্র রাখার ফাইল, হ্যান্ড ব্যাগ, শরণার্থীদের সম্পর্কে সচেতনতা মূলক ব্যাজ, রিষ্ট ব্যান্ড বা পতাকা।
মেকারস ইউনাইট এর প্রতিষ্ঠাতা টমি স্ফাইশলার। তিনি বলছেন, তারা ইউরোপের সবচাইতে দীর্ঘতম অভিবাসী সঙ্কট নিয়ে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করতে চান।
তিনি বলছেন, "আমাদের জন্য এই লাইফভেস্টগুলো হচ্ছে একটি আলোচনার শুরু। আমরা চাই এই পণ্যগুলো সমাজে একটা আলোচনা তৈরি করুক। এই যে এতো শরণার্থীরা আসছেন তাদের সমাজে জায়গা করে দিতে আমরা কি করতে পারি? আমরা কি সমস্যা লুকিয়ে রাখবো? নাকি এ নিয়ে কিছু করবো? আমরা এভাবে আলাপটা শুরু করছি। আমরা তাদের জন্য জীবিকার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে তাদের জন্য কিছু একটা করছি।"এই কাজের মাধ্যমে জীবনে দ্বিতীয়বার সুযোগ পেয়েছেন সিরিয়ার আলেপ্পোর বাসিন্দা আমার হাজ ওমার।
যিনি পেশায় একজন দর্জি ছিলেন। "আমি এখানে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ অনুভব করছি। আমি সিরিয়াতে যখন কাজ করতাম এখানেও সেই একই কাজ করছি। আমি সুখী।"
এখানেও তার গলায় ঝোলানো আছে মাপ দেয়ার টেপ।
যুদ্ধের হাত থেকে সমুদ্র পথে পালিয়ে আসার সময় যে লাইফ জ্যাকেট তার জীবন বাঁচিয়েছে, আজ সেই কমলা রঙের লাইফ জ্যাকেটটি তার জন্য আয়ের সুযোগ ও করে দিচ্ছে।
লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা কেমন আছেন
লেবাননে বুর্জ আল বারাজনেহর একটি শরণার্থী শিবির। সেখানে একেকটা বাড়ির মাথায় উড়ছে ফিলিস্তিনি পতাকা। সরু সরু রাস্তা। উপরে মাকড়সার জালের মতো পেচানো বিদ্যুতের তার।
স্পিকারে খুব জোরে জাতীয়তাবাদী গান বাজিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল একটি গাড়ি।
এই শরণার্থী শিবিরে বসবাস করা খুব একটা সুখকর নয়। বেঁচে থাকার অর্থ রোজগারের জন্যে কোনো কাজ নেই। বসবাসের পরিবেশও খুব খারাপ। এই ক্যাম্পে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবসে কথা বলছিলো পেছনে ফেলে আসা তাদের বাড়িঘর সম্পর্কে।
একজন শরণার্থী বললেন, "আমাদের জন্যে এই নাকবা খুব খারাপ একটি দিন। নিজেদের দেশ ও ভূমির কথা আমাদের মনে পড়ে। এরকম একটা খারাপ পরিবেশে আমরা কেন বসবাস করছি?"
আরেকজন নারী শরণার্থী বলেন, "আমার বয়স ১৫। লেবাননেই আমার জন্ম। এখানেই আমি বড় হয়েছি। কিন্তু আমার দাদা দাদী নানা নানী তারা সবাই তাদের ফেলে আসা জীবনের কথা বলেন। আমার বাবা মাও সেসব দেখেননি। কিন্তু তারপরেও তারা ফিলিস্তিনে ফিরে যেতে চান। আমিও চাই ফিরে যেতে।"
এটিকে ক্যাম্প বলা হলেও এখানে কোনো তাবু নেই, নেই অস্থায়ী বাড়িঘরের কোন কাঠামো। কিন্তু তারপরেও এটিকে ক্যাম্প বলা হয় কেন? কারণ ফিলিস্তিনিরা মনে করেন লেবাননের এই জায়গাটি তাদের অস্থায়ী ঠিকানা। তারা স্বপ্ন দেখেন ৭০ বছর আগে তারা যেখান থেকে পালিয়ে এসেছেন, কিম্বা তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে, সেখানে তারা একদিন ফিরে যাবেন।
"নিজের ভূমি থেকে দূরে থাকা খুব কঠিন। সেখানে আমরা যেতেও পারি না। আল্লাহ চাইলে আমি আমার নিজের দেশে মরতে চাই। আমি চাই সেখানেই আমার কবর হোক। আমার বিশ্বাস একদিন আমরা ফিরে যাবো এবং সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে," বললেন একজন।
লেবাননের এরকম বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করেন প্রায় পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী। তাদের বেশিরভাগই ১৯৪৮ সালের ইসরাইল-আরব যুদ্ধের সময় নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন, কিম্বা তাদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৭০ বছর আগের ১৫ মে, ফিলিস্তিনিরা যেদিনটিকে পালন করে নাকবা দিবস হিসেবে। শরণার্থীরা বহু বহু বছর ধরে লেবাননে বসবাস করলেও তাদের জীবন যাপন অনেক সীমিত। বঞ্চিত অনেক অধিকার থেকেও।
এরা যে শুধু ইসরাইলের সাথে যুদ্ধের কারণে শরণার্থী হয়েছেন তা নয়। লেবাননেও একটি জাতিগোষ্ঠীর সাথে তাদের যুদ্ধ চলছে। দেশটিতে এতোরকমের গোষ্ঠী আছে যে কখন কোন গ্রুপ কার সাথে যুদ্ধ করছে সেটা বুঝতে পারাও খুব কঠিন।
লেবাননের জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজন সবসময়ই বিস্ফোরকের মতো। বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে লেবাননের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। তাদের অনেক কাজের ওপরে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে।
নির্ধারিত ক্যাম্পের বাইরে আর কোথাও তাদের বসবাসের অনুমতি নেই। তারা জায়গা জমি কিম্বা বাড়িঘরও কিনতে পারে না।
জানা আল মাওয়া এই ক্যাম্পেরই একজন শিক্ষক। তিনি বলছেন, "ফিলিস্তিনি ছেলেমেয়েরা ছেঁড়া ও ময়লা জামা কাপড় পরে। তারা যখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায় তাদেরকে দেখা হয় বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে।"
"এখানে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা মনে করে তারা যদি লেবানিজ সমাজের সাথে মেলামেশা করেন তাহলে তারা হয়তো তাদের ফিলিস্তিনি পরিচয় হারিয়ে ফেলবেন," বলেন তিনি।
লেবাননের একজন এমপি নাদিম জামায়েল মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের সমান অধিকার দিতে তার দেশ এখনও প্রস্তুত নয়।
"ফিলিস্তিনিরা এখানে আছেন শরণার্থী হিসেবে। তাদের নাগরিকত্ব বা অন্যান্য অধিকার দেয়া সম্ভব নয়। সেরকম কিছু হলে, লেবাননের বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে সম্প্রীতি আছে, সেটা নষ্ট হবে। সেটা করতে দেয়া যাবে না।"
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন