ইরানের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার এবং নতুন একটি পরমাণু চুক্তির জন্য ইরানকে ১২টি শর্ত দিয়েছে আমেরিকা।
১২টি শর্ত না মানলে ইরানের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে কঠোর অবরোধের হুমকি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও।
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিকদের উদ্দেশে এক বক্তব্যে মাইক পম্পেও এ হুমকি দেন।
এদিকে, আমেরিকার পক্ষ থেকে ওই শর্ত ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সোমবার স্থানীয় সময় রাতে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমেরিকার দেয়া শর্ত আমরা গ্রহণ করবো না। আমেরিকা যেসব শর্ত দিচ্ছে বা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা বিশ্বের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে।
এসময় তিনি এসব শর্তকে ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক বলে অভিহিত করেন।
যে শর্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আবারো বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আসুন জেনে নেই কি আছে সেই শর্তে। নিম্নে সেই শর্তগুলো উল্লেখ করা হলো-
আমেরিকার দেয়া ১২ শর্ত:
১. ইরানকে অবশ্যই ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম সমৃদ্ধ করা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া পরমাণু অস্ত্র বানানোর জন্য ব্যবহৃত ভারী পানি মজুদ করাও বন্ধ করতে হবে।
আমেরিকা নতুন এ শর্ত দেয়ার আগেই ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি থেকে আমেরিকা বেরিয়ে যাওয়ার পর ইউরেনিয়াম মজুদ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ইরান।
২. ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি কমিশন (আইএইএ)কে ইরানে প্রবেশ এবং ইরানের সকল পরমাণু কেন্দ্রে অবাদ প্রবেশের অনুমতি দিতে হবে।
যদিও ২০১৫ সালের চুক্তির পর থেকে আইএইএ প্রতিনিধিদের ইরানের প্রবেশে বাঁধা নেই। ওই চুক্তির পর আইএইএ প্রতিনিধিরা নিয়মিত ইরানি পরমাণু কেন্দ্র পরিদর্শন করে এবং ইরান চুক্তি মেনে চলছে বলে তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩. ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি কমিশন (আইএইএ) এর পক্ষ থেকে ইরানের পরমাণু কেন্দ্র পরীক্ষার পর এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, ইরানের পরমাণু কেন্দ্র কোনোভাবেই সামরিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে না।
তবে ইরান তার পরমাণু কেন্দ্র শান্তিপূর্ণে কাজে ব্যবহার করছে বলে দাবি করে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি কমিশন (আইএইএ) এর রিপোর্টেও একই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
৪. ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। এছাড়া পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম মিসাইল পরীক্ষা বা উন্নয়ন বন্ধ করতে হবে।
২০১৫ সালের চুক্তির পর ইরান পরমাণু অস্ত্র না বানালেও প্রতিরক্ষার জন্য নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু ট্রাম্পের দেয়া নতুন শর্তে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে।
৫. ইরানে বন্দি আমেরিকার সকল নাগরিককে মুক্তি দিতে হবে। এছাড়া আমেরিকার কোনো নাগরিকের পরিবাররের কোনো সদস্য বা আত্মীয় বন্দি থাকলে তাদেরও মুক্তির পাশাপাশি আমেরিকার সাথে কোনো কার্যক্রমে জড়িত এমন যে কাউকে মুক্তি দিতে হবে।
উল্লেখ্য, আমেরিকার পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করার অভিযোগে বেশ কয়েকজন আমেরিকান ও ইরানি নাগরিক বন্দি রয়েছেন। ট্রাম্পের এ শর্তের মাধ্যমে তাদের মুক্তি দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
৬. ইসলামিক সংগঠন হিজবুল্লাহ ও হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন উল্লেখ করে তাদের সব ধরনের সমর্থন দেয়া বন্ধ করার শর্ত দেয়া হয়েছে।
আমেরিকার পক্ষ থেকে হিজবুল্লাহ ও হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করা হলেও ইরান তাদেরকে ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে মনে করে। ফলে ইরানের সাথে তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।
৭. ইরাক সরকারকে সার্বভৌম মনে করা। এছাড়া সেখানকার শিয়া যোদ্ধাদের নিরস্ত্রীকরণ করা।
উল্লেখ্য, ইরান শিয়া অধ্যূষিত রাষ্ট্র হওয়া পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষ করে ইরাকের শিয়াদের সাথে ইরানের সুসম্পর্ক রয়েছে।
৮. ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সামরিক সহায়তা বন্ধ করা এবং সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক সমঝোতা করা।
প্রসঙ্গত যে, ইয়েমেনের হুথিদের ইরান সামরিক সহায়তা দিচ্ছে বলে দীর্ঘ দিন ধরে আমেরিকা অভিযোগ করে আসছে। কিন্তু ইরান বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে। এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে এখনো আমেরিকার পক্ষ থেকে কোনো অকাট্য প্রমাণ উপস্থান করা সম্ভব হয়নি।
৯. সিরিয়ায় নিয়োজিত ইরানি বাহিনী প্রত্যাহার করা।
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের পক্ষে সেখানে কাজ করছে ইরানি বাহিনী। ইরানি বাহিনী ছাড়াও সেখানে রাশিয়ান বাহিনী রয়েছে। সিরিয়ায় ইরানি বাহিনী থাকার কারণে দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইল উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে।
১০. আফাগানিস্তানে তালিবানদের সমর্থন বন্ধ করা এবং আল কায়েদার সিনিয়র নেতাদের সহায়তা দেয়া বন্ধ করা।
উল্লেখ্য, তালিবানদের সহায়তা দেয়ার যে অভিযোগ আমেরিকা করে আসছে তা অস্বীকার করছে ইরান। ইরান নিজেও তালিবানদের বিরুদ্ধে বলে দাবি করে থাকে।
১১. ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী ও যোদ্ধাদের দেয়া সমর্থন বন্ধ করা।
আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনলেও তার কোনো প্রমান দিতে পারেনি। এছাড়া ইরানও নিজেদেরকে সবসময় সন্ত্রাসী ও যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বলে দাবি করে।
১২. পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের প্রতি ইরানের বৈরিভাব বন্ধ করা। বিশেষ করে সৌদি আর, আরব আমিরাত এবং ইসরাইলের প্রতি বিদ্বেষ বন্ধ করা এবং ইসরাইলকে ধ্বংস করার হুমকি থেকে সরে আসা। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সাইবার হামলা বন্ধ করা।
উল্লেখ্য, ইসরাইলকে এখনো ইরানের পক্ষ থেকে বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এছাড়া আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সাথে ইরানের সম্পর্ক খারাপ। অন্যদিকে এ দেশ তিনটির সাথে আমেরিকার মিত্রতা রয়েছে। এছাড়া আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে সাইবার হামলার অভিযোগ করলেও ইরানের বিরুদ্ধে সাইবার হামলার কোনো অভিযোগ এখনো প্রমান হয়নি।
২০১৫ সালের জুনে তেহরানের সঙ্গে পরমাণু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬ জাতিগোষ্ঠীর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গত ৮ মে ইরানের বিরুদ্ধে সমঝোতা ক্ষুন্নের অভিযোগ তুলে পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন