ভারতে কোল্টান বা কোনো বিরল ধতুর খনি নেই, তেল আছে সামান্য, আর পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। দেশটির যা আছে তা হল ১৩০ কোটির বেশি মানুষ। বর্তমান পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের তথ্যকে মাটির নিচের তেলের মতই মূল্যবান মনে করা হচ্ছে। বিশাল জনগোষ্ঠীর কারনে ভারতের কাছে এই ‘নতুন তেল’ প্রচুর পরিমাণে থাকায় এদিক থেকে ভারতের সম্ভাব্য সম্পদের পরিমাণ বিশাল। কিন্তু এই তথ্য থেকে উপকৃত হবে কারা এবং কারা ঝুঁকিতে পড়তে পারে?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিঃসন্দেহে তথ্য সংগ্রহ করতে পছন্দ করেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ডিজিটাল শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং এর দেশকে বদলে দেয়ার সামর্থ্যের উচ্চ প্রশংসা করে এটি বিস্তৃত করার জন্য বিশেষ উৎসাহী হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এখন স্কুলে ছাত্র ও শিক্ষকদের এবং অফিসে সরকারী কর্মচারীদের উপস্থিতি সহজেই নির্ণয় করা যায়। ২০১৬ সালে তার নোট বাতিল করার সিদ্ধান্তের পর মোদি ভারতীয়দের নগদ টাকার পরিবর্তে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থ আদান প্রদানের উপদেশ দেন।
আরও উচ্চাভিলাষী হয়ে মোদীর সরকার সব ভারতীয়কে একটি বিশেষ ‘ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার বা স্বতন্ত্র শনাক্তকরণ সংখ্যা’ প্রদানের ব্যবস্থাকে আরও বিস্তৃত করে। আধার নামে পরিচিত এই ব্যবস্থাটি বায়োমেট্রিক তথ্যের সাথে যুক্ত। আগের কংগ্রেস সরকারের চালু করা এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারি বিভিন্ন সুবিধার ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের ভর্তুকির ‘ভূতুড়ে সুবিধাভোগীদের’ নির্মূল করা।
আধার প্রকল্প চালু করার সময়, মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তখন তিনি এটির তীব্র বিরোধিতা করেন এবং ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসলে এটি বাতিল করার প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়ে মোদি এই প্রকল্প সাদরে গ্রহণ করেন এবং প্রায় সব কিছুর সাথে এই শনাক্তকরণ সংখ্যা যুক্ত করার নির্দেশ দেন। ব্যাংক একাউন্ট, স্কুলে ভর্তি ও মোবাইল ফোন চুক্তি, ভ্রমণের রেকর্ড, হাসপাতালে ভর্তি এমনকি শ্মশানে পোড়ানোর সার্টিফিকেটেও এখন আধার নাম্বার লাগে। অথচ সুপ্রিম কোর্টকে মোদি আশ্বস্ত করেছিলেন এই প্রকল্পের আওতায় আসা বাধ্যতামূলক নয়।
মোদির লক্ষ্য রাজনৈতিক কর্তৃত্ব
মোদির উদ্দেশ্য হচ্ছে দক্ষতা বৃদ্ধির চেয়ে অনেক অনেক সুদূরপ্রসারি। তিনি নিঃসঙ্কোচে জানিয়েছেন তথ্য হচ্ছে ‘আসল সম্পদ’, এবং এটা ‘যেই সংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণ’ করতে পারবে, সেই ‘কর্তৃত্ব’ করতে সক্ষম হবে। আর রাজনৈতিক কর্তৃত্বই হচ্ছে মোদির লক্ষ্য। তিনি গত চার বছর ক্ষমতা কেন্দ্রিভুত ও পাকাপোক্ত করার কাজ করেছেন এবং তার দল বিজেপি ২৯টির মধ্যে ২২ রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
কিন্তু, বিশাল দেশের বিশাল তথ্য নিয়ে সম্পর্কে মোদির পরিকল্পনা অনেকগুলো বাধার সম্মুখীন হয়েছে। আধার নম্বরের মালিকদের পরিচয় নিশ্চিত করার মেশিন প্রায়ই অকেজো হয়ে পড়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে এমনটা বেশি হয়েছে। এর ফলে, গরীবদের কোনো উপকার তো হয়নি, বরং আধার প্রকল্পের কারনে অনেক গরিব মানুষ তাদের রেশন সাপ্লাই তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, যাতে তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
এই অবস্থাকে আরও খারাপ হয়েছে আধারের তথ্য বিভিন্নভাবে ফাঁস হয়ে যাওয়ায়। দ্য ট্রিবিউন পত্রিকার একজন অনুসন্ধানী প্রতিবেদক মাত্র ৫০০ রুপি (৮ ডলার) দিয়ে ৫০ মানুষের আইডি নাম্বার কিনে নিতে পেরেছেন। একটি সরকারী তেল ও গ্যাস কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে ন্যূনতম প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম এমন যে কেউ ৫০ কোটি ভারতীয়ের নাম, ব্যাংক একাউন্টের খুঁটিনাটি এবং তাদের আধার নাম্বার বের করতে পারবেন।
পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ভুলক্রমে প্রায় ১.৬ কোটি মানুষের আধার নাম্বার প্রকাশ করে দেয়। দক্ষিণের অন্ধ্র প্রদেশের ২০ কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য অগোছালো কর্মীদের একটি নেটওয়ার্কে প্রকাশ হয়ে পড়ে।
অস্বীকার, আত্মতৃপ্তি, গোপনীয়তা
সামগ্রিকভাবে আধার বা ব্যক্তিগত তথ্যের প্রকল্পের কারনে ভারতীয়রা ফেসবুকের ৮.৭ কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিতে আছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য অনুচিতভাবে রাজনৈতিক পরামর্শ দেয়ার প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় পৃথিবীজুড়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। তারপরও, এমন খবর বেরোনোর পর মোদির সরকার শুধু তা অস্বীকার করে আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করেছে ও গোপনীয়তা বজায় রেখেছে।
তথ্য সুরক্ষায় মোদি সরকারের ব্যর্থতার একটা প্যাটার্ন আছে বলে মনে হয়। ২০১৫ সালে তিনি ‘নরেন্দ্র মোদী মোবাইল অ্যাপ’ ডাউনলোড ও ইন্সটল করে তার সমর্থকদের ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সরাসরি মেসেজ ও ইমেইল গ্রহণের আমন্ত্রণ’ জানান। তার প্রতিশ্রুতি ছিল তার বক্তব্য আর মানুষের মাঝখানে ‘কোনো মধ্যস্থতাকারী, কোনো মিডিয়া, কোনো কর্মকর্তা, কোনো লাল ফিতা থাকবে না’। ওই অ্যাপটি ৫০ লক্ষবারেরও বেশিবার স্মার্টফোনে ডাউনলোড করা হয়।
কিন্তু এতে একটা ঘাপলা আছে। এটি ব্যবহারের সময় মোদির অনুসারিরা তাদের ছবি, পরিচিত লোকজনের যোগাযোগের তালিকা, অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য ও তাদের ফোনের মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা মোদি অ্যাপটিকে ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়। সম্মতি দেয়া তো দূরে থাক, অ্যাপটির ব্যবহারকারীরা জানতেনও না এমনটি ঘটবে, কারণ অ্যাপের কোথাও এসবের উল্লেখ ছিল না।
অ্যাপটির প্রাইভেসি পলিসি ব্যক্তিগত তথ্যের নীতিমালা এখন পরিবর্তন করা হলেও ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করা তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানটির কাছে রয়ে গেছে। এই তথ্য তারা এখনই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে, এবং ভবিষ্যতে কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে তা কেউ জানে না।
আগামী দিনগুলোতে তথ্য সংগ্রহ ও সুরক্ষিত করার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ শুধুই বাড়বে। ধারণা করা হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর মোট তথ্যের ৯০% গত দুই বছরে সংগ্রহ করা হয়েছে। ভারতে এই শতাংশ হারের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। ফোর-জি সার্ভিস আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় এবং ইন্টারনেট যুক্ত স্মার্টফোন আরও সুলভ হয়ে ওঠায় লাখ লাখ মানুষ অনলাইনে আসছে, এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য দিচ্ছে।
ভারত হবে ‘বিগ ডাটা’ বা ‘বিশাল তথ্য ভাণ্ডারের’ দেশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একই সাথে এটা ‘বিশাল তথ্য ফাঁসের’ দেশও হয়ে উঠবে কি না। এখন পর্যন্ত দেশটিতে তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা বজায় রাখার শক্তিশালী আইন নেই। পার্লামেন্টে এমন বিলের প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য আমার চেষ্টা বার বার রুখে দেয়া হয়েছে। যে তথ্য মোদির এত প্রিয়, সেগুলো যারা দিচ্ছেন তাদের সুরক্ষা দিতে মোদিকে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ‘ minimum government, maximum governance অর্থাৎ ন্যূনতম সরকার, সর্বাধিক শাসন’ অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
লেখক পরিচিতি: শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও মানব উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কপিরাইট: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন