পাহাড়ের কোল ঘেষে ছোট্ট একটা গ্রাম। শ্রীলঙ্কার সেই গ্রামটিতে পাকা রাস্তা বা পানির লাইন না পৌঁছলেও স্মার্টফোন পৌঁছে গেছে অনেক আগেই। তার হাত ধরে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে ফেসবুকও। সেখানে বাস করে ১৩ সদস্যের একটি পরিবার। একটি স্মার্টফোনে ঘুরছে সবার হাতে। মাসখানেক আগে এই পরিবারেরই এক সদস্য গণপিটুনিতে মারা যান। পেশায় তিনি ছিলেন ট্রাকচালক।
পরিবারের কাছে খবর এসেছিল, ট্রাফিক আইন ভাঙা নিয়েই হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন ওই ট্রাকচালক। কিন্তু কয়েকদিন পরেই ওই ট্রাকচালকের ছবি দিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট ছড়ানো হয়। বলা হয়, ‘শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের দেশছাড়া করতে এভাবেই হামলা চালাচ্ছে মুসলিমরা।’
সেই ফেসবুক পোস্টেই চোখ ট্রাক চালকের পরিবারের। বৌদ্ধ এই পরিবারের সদস্য এইচ এম লালের কথায়, ‘এটা যদি সত্যি হয়, প্রতিশোধ নিতে ছাড়ব না।’
একটা একটা দৃষ্টান্ত মাত্র! কিন্তু এভাবেই সামাজিকমাধ্যমে পাখা মেলছে হাজারো গুজব আর ভুয়া সংবাদ। সত্য-মিথ্য বিচার না করেই জ্বলে উঠছে প্রতিশোধের আগুন। তাতে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
এমন একটি ফেসবুক পোস্টে ছড়িয়েছিল, ‘আম্পারায় সিংহলিদের নিবীর্যকরণের চেষ্টা করছে মুসলিমরা। নিবীর্যকরণের ২৩ হাজার ওষুধ সম্প্রতি পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে, সকলে সতর্ক হোন।’
এর কিছুদিন পরই আম্পারায় একটি হোটেলে হামলা হয়। হোটেলটির মালিক মুসলিম। সিংহলি এক ক্রেতা খাবার নিয়ে কিছু অভিযোগ করছিলেন। তামিলভাষী মালিক বক্তব্য বুঝতে পারেননি।
উঠে গিয়ে দেখেন খাবারে ময়দা জাতীয় কিছু দেখিয়ে ক্রেতা চেঁচামেচি করছেন। তিনি ময়দা দিয়েছেন কি না- সে প্রশ্ন করা হচ্ছে ভেবে মাথা নাড়েন হোটেল মালিক। আর তাতেই বিপত্তি। কারণ সিংহলি ওই ক্রেতার প্রশ্ন ছিল- ওটা নিবীর্যকরণের ওষুধ কি না।
ভাষার বিভ্রাটে মুহূর্তে হোটেল ধ্বংসস্তূপ। পুরো ঘটনার ভিডিও তুলে ফেসবুকে দিয়ে দাবি করা হয়, নিবীর্যকরণের দাবি পুরোপুরি সত্য। শ্রীলঙ্কায় অশান্তির আগুনে ইন্ধন জুগিয়েছে ফেসবুকের এমন অনেক গুজব।
দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা ফেসবুকের কাছে অভিযোগ জানিয়েও বিশেষ কোনো ফল পাননি। ঠিক এমনই হয়েছিল মিয়ানমারেও। সেখানে কট্টর বৌদ্ধদের একটি দল ফেসবুকে উস্কানিমূলক পোস্ট ছড়িয়েছিল। যার জেরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাখাইনের গ্রামে আগুন জ্বলে। ভারতেও একই চিত্র। ফেসবুকের খবরকে কেন্দ্র করে কখনও গড়ে ওঠে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। তাতে হামলার পরিকল্পনা চলে। শেয়ার হতে থাকে বিদ্বেষমূলক মেসেজ ও ভিডিও।
ফেসবুককে বহুবার এ নিয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। পশ্চিমা দুনিয়ায় নির্বাচনী প্রচারেই সামাজিকমাধ্যমের ব্যবহার বেশি। ফলে মার্কিন এই সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপত্তার মাপকাঠিতে এশিয়ার দেশগুলোর সাম্প্রদায়িক অশান্তির আঁচ ধরা পড়ে না। এতে নির্বিঘ্নে দাবানল ছড়ায় গুজব। বলি হয় নিরীহ প্রাণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামাজিকমাধ্যম এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে এটি একদিন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব’ হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রাজনীতিতে ইতোমধ্যে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে ফেসবুকের মতো সামাজিকমাধ্যমগুলো। যেখানে প্রচলিত গণমাধ্যম ভূমিকা রাখতে পারছে না, সেখানে সামাজিকমাধ্যমই হয়ে উঠছে ভরসা।
সমাজের অভ্যন্তরের নানা খবর দিচ্ছে এই মাধ্যম। সঙ্গে উপার্জনের ভালো উৎসও হয়ে উঠেছে। তবে অনেকেই সেই উপার্জনের জন্য নানা ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিকমাধ্যমে। এতে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে সহিংসতার ঘটনা। এর নেতিবাচক ব্যবহার রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন