চীন ভারতের কাছে হিমালয় অঞ্চলে ত্রিদেশীয় অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণের প্রস্তাব দিতে পারে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই পরিকল্পনার অধীনে ভারত, চীন ও নেপালকে সংযুক্ত করা হবে। তবে, এই প্রস্তাব নয়াদিল্লীর দিক থেকে সামান্যই সাড়া পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ বেইজিংয়ের সম্প্রসারণশীল অবকাঠামো প্রকল্পগুলো নিয়ে এরইমধ্যে ভারত তাদের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে।
বেইজিংয়ে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ কুমার গিয়াওয়ালির সাথে বৈঠকের পর চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, “হিমালয় অঞ্চল দিয়ে আমাদের ত্রি-মাত্রিক সংযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা উচিত। চীন ও নেপাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে, যেখানে সংযোগ স্থাপন একটা প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”
চীন ও নেপাল রেল, সড়ক, বিমান, বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ খাতে ধীরে ধীরে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী – এমন তথ্য জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “এর ফলে একটা পরিবেশ তৈরি হবে এবং চীন, নেপাল এবং ভারতের মধ্যে ত্রিদেশী ইকোনমিক করিডোর গড়ে তোলা সহজ হবে, যেটা ভবিষ্যতে গড়ে উঠতে পারে।”
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের চারদিনের চীন সফর শুরুর আগে ওয়াং এ মন্তব্য করলেন। শনিবার স্বরাজের ওই সফর শুরু হবে। ওয়াংয়ের সাথে বৈঠক ছাড়াও স্বরাজ ২৪ এপ্রিল সাংহাই কোঅপারেশান অর্গানাইজেশানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিবেন।
এই সফরে দুই দেশ তাদের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা করবেন। গত বছর দোকলামে সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়ায় দুই দেশের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। ওই অচলাবস্থা দুই মাসেরও বেশি স্থায়ী হয়েছিল। স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকে চীন ত্রিদেশীয় অর্থনৈতিক করিডোরের প্রসঙ্গটি তুলতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
নয়াদিল্লীতে ইন্সটিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের সহযোগী ফেলো প্রশান্ত কুমার সিং নিক্কি এশিয়ান রিভিউকে বলেন, “চীন ভারতকে (ত্রিদেশীয় করিডোর নিয়ে) বোঝানোর চেষ্টা করবে কিন্তু সফল হবে না।”
তিনি বলেন, এ ধরনের প্রকল্পের ব্যাপারে সম্মত হওয়ার আগে ভারত সার্বিক আস্থা ও স্বচ্ছতার পরিবেশ খুঁজবে, যেটা চীনের সাথে তাদের নেই। চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিআরআই প্রকল্পের অংশ চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) নিয়ে দিল্লী এরইমধ্যে বেইজিংয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট।
৬০ বিলিয়ন ডলারের সিপিইসি বিতর্কিত কাশ্মীর এলাকা দিয়ে গেছে। এটা ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ – এই যুক্তিতে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে নয়াদিল্লী।
৫ এপ্রিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিআরআইয়ের ব্যাপারে তাদের অবস্থান আবারও খোলাসা করেছে। ভারত চীনকে বিআরআই নিয়ে সহযোগিতা করতে পারে, মিডিয়ায় এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশের পর মন্ত্রণালয় থেকে ওই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। এতে বলা হয়, “ভারতের অবস্থান অপরিবর্তিতই রয়েছে এবং এতে কোন পরিবর্তন হয়নি।”
এতে আরও বলা হয়, “চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে লঙ্ঘন করেছে। কোন দেশই এমন কোন প্রকল্পকে মেনে নিতে পারে না, যেটা তাদের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে অগ্রাহ্য করে।”
নেপাল ও ভারতের সাথে ত্রিদেশীয় করিডোরকে চীন দেখছে সস্তা পণ্য রফতানির সুযোগ হিসেবে।
নয়াদিল্লীর কাছে সোনিপাত এলাকায় ও.পি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সের সাবেক গবেষক পঙ্কজ ঝা বলেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেপালের সাথে ঐতিহাসিকভাবে খোলা সীমান্ত রয়েছে ভারতের। তাছাড়া চীনা পণ্যের ব্যাপারে ভারতের অনীহাও রয়েছে।
তিনি বলেন, চীন এরইমধ্যে থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে তাদের পণ্য ভারতে পাঠাচ্ছে। তাছাড়া ভারতের সাথে চীনের বিশাল বাণিজ্য ব্যবধান তো রয়েছেই।
ঝা বলেন, “চীন এখন এই ত্রিদেশীয় করিডোর তৈরি করতে চায় যাতে ভারত ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেপালকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ভারতের এ ব্যাপারে অত আগ্রহ নেই, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় পণ্যবাহী যানবাহনকে ছাড়পত্র দেয়ার জন্য যেহেতু তাদের যথেষ্ট শুল্ক অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি।”
তিনি আরও বলেন, “ভারত মনে করে যদি তারা নেপালকে চীনের হাতে ছেড়ে দেয়, তাহলে ভারতের পুরো উত্তরাঞ্চল চীনের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাবে এবং চীন (নেপাল প্রান্ত দিয়ে) সীমান্তের খুব কাছে চলে আসবে।”
ভারত ও চীন দুটো পারমানবিক শক্তিধর দেশ যাদের মধ্যে দীর্ঘ সঙ্ঘাতপূর্ণ সম্পর্ক চলে আসছে। দুই দেশের মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে ১৯৬২ সালে দুই দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছে। আঞ্চলিক এই্ দেশ দুটো তাদের প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোসহ অন্যান্য দেশের উপর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে। এখানে ভারতেরও নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংযোগ প্রকল্প রয়েছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বাড়াতে ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মধ্যে ত্রিদেশীয় হাইওয়ে নির্মাণ করছে তারা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন