‘জানমালের নিরাপত্তা দিতে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে আমি ২০ বছর ধরে কাজ করতেছি। অথচ আমার লাইসেন্স করা কোনো অস্ত্র, বন্দুক নাই। দুই-চার জন লোক যদি চুরি-ডাকাতি বা অন্য কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আমার ওপর আক্রমণ করে, আমার কিছু করার নাই। বাধা দিলে নির্ঘাত মৃত্যু, কোনো ভুল নাই। বাধা না দিলেও ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রতিষ্ঠান আমাদের ধরবে।’
রাজধানীর গুলশান-১ এলাকায় দায়িত্ব পালনের সময় এসব কথা বলেন নিরাপত্তাকর্মী মো. ইসহাক আলী।
নিরাপত্তাকর্মী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিকিউরেক্সের হয়ে কাজ করেন ইসহাক আলী। তিনি বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তা দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলেও আমাদের নিজেদের কোনো নিরাপত্তা নাই।’
ইসহাক আলীর মতো রাজধানীতে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন ভবনের কর্মীদের নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা। আত্মরক্ষার্থে তাদের কাছে ছোট একটি লাঠি ছাড়া যেমন তেমন কিছুই থাকে না। কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হয়, সেই বিষয়ে নেই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণও। নামমাত্র কিছু বিষয় শিখিয়ে দিয়ে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে তাদের নিয়োগ দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো।
রাজধানীর ছয়টি দেশি-বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১১ নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলার পর এমন বিষয় বেরিয়ে এসেছে। চাকরির সুরক্ষার স্বার্থে তাদের বেশির ভাগই নাম প্রকাশ করতে চাননি।
রাজধানীর গুলশানে যমুনা ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন মশিউর রহমান। নিরাপত্তাকর্মী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বেস্ট সিকিউরিটাসের দেওয়া পোশাক পরে বুথের সামনে টুলে বসেছিলেন তিনি। তার কাছে আর কোনো ধরনের সরঞ্জাম ছিল না।
নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে মশিউর রহমান বলেন, ‘পরিস্থিতির তৈরি হলে প্রথমে ঠেকানোর চেষ্টা করব, না পারলে প্রতিষ্ঠানকে ফোন দিয়ে জানাতে হবে।’
১১ জনের মধ্যে আটজনই জানান, তারা চাকরি শুরুর আগে এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাকি তিনজনের একজন ১৮ দিন, অন্য দুজন এক মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে জানান।
এই ১১ জনের নয়জনই জানান, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে, প্রশিক্ষণের সময় তাদের তা শেখানো হয়নি। তবে ১৮ দিন প্রশিক্ষণ করা নিরাপত্তাকর্মী জানান, প্রশিক্ষণের সময় তাদের কারাতে জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল, ওইটুকুতেই শেষ।
এ বিষয়ে মশিউর রহমান বলেন, ‘কীভাবে সালাম দিতে হয়, কার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়, এগুলো শিখাইসে। কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে, এই বিষয়ে তেমন কিছুই শিখায়নি।’
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেরা নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে। এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর গুলশানের ১ নম্বরের উদয় টাওয়ার। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ২০ জন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের তত্ত্বাবধায়ক মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের তেমন কোনো প্রশিক্ষণ করানো হয়নি। তবে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আমাদের ক্লাস করাইসেন। সেখানে আমাদের বোঝানো হইসে, আগুন ধরলে কী করতে হবে? ভবনে আগুন নির্বাপক সবকিছু লাগানো আছে, ওই পরিস্থিতিতে এগুলো কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেইটা শেখানো হইছে। এ ছাড়া আর কিছু না।’
আক্তারুজ্জামান জানান, অগ্নেয়াস্ত্র কোনো মালিক বা প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া হয় না। কোনো নিরাপত্তাকর্মী যদি অস্ত্রের লাইসেন্স করে, তাহলে তাকে প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি বেতনে চাকরি দিয়ে থাকে। ব্যাংকে কর্মরত কিছু নিরাপত্তাকর্মীর অস্ত্র কিনে দেয় প্রতিষ্ঠান। তবে সেটা প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স করা হয় না, ওই নিরাপত্তাকর্মীর নামে করা হয়ে থাকে। যদি নিরাপত্তাকর্মীর অস্ত্র কেনার টাকা না থাকে, সে ক্ষেত্রে ওই ব্যাংক ঋণ দিয়ে তাকে অস্ত্র কিনে দেয়। তবে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে ওই ব্যাংকে চাকরি করতে হয়।
আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘কেউ যদি আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, তাহলেও কিছু করার নেই। এমনকি চড় মারলেও কিছু করার নেই। পাঁচজনের সাথে ভালো ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ বলবে এই নিরাপত্তাকর্মী ভালো। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মীর ওপর যখন আক্রমণ হবে, এটা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নিরাপত্তাকর্মীর নাই।
যখন প্রতিরোধ করব, তখন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বলবে, এটা তুমি করলা কেন? তোমার নামে অভিযোগ আসছে, তোমার ব্যবহার খারাপ, তোমার চাকরির দরকার নাই। এই কথা নিরাপত্তাকর্মী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বা নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেওয়া প্রতিষ্ঠান, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তাকর্মীদের পক্ষ নেয়-এমন প্রতিষ্ঠান শতকরা পাঁচটাও পাওয়া যাবে না। আমরা ভবনের নিরাপত্তার জন্য থাকলেও আমাদের কোনো নিরাপত্তা নাই।’
উদয় টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী রুবেল জানান, ব্যাংকে যারা কাজ করে, তাদের কিছু কিছু আনসার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসে। অনেকে আবার সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর এই কাজে আসে। তাদেরই কেবল আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ থাকে।
গুলশানের সুবাস্তু ইমাম স্কয়ারের নিরাপত্তাকর্মী আসাদ বলেন, ‘আমরা আগে আমাদের প্রতিষ্ঠানকে জানাই। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাই। কিন্তু এখানে যদি বিক্ষোভকারী, অস্ত্রধারীরা হামলা করে তাহলে আমাদের করার কিছু নাই। মেরে ফেললেও প্রাথমিকভাবে আমাদের আত্মরক্ষার কোনো উপায় নাই।’
প্রায় দুই হাজার নিরাপত্তাকর্মী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত রয়েছে কমান্ডো গার্ড লিমিটেডের। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে যাদের অভিজ্ঞতা নেই, তাদেরকে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলি। বিনা অস্ত্রে কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, কীভাবে সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়, কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে কীভাবে নিজেকে ও প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তা দেওয়া যায়, সে জন্য আমরা তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।
চাকরি শুরুর আগে ২১ দিন এবং চাকরিতে কর্তব্যরত অবস্থায়ও আমরা প্রশিক্ষণ দিই। শুধু নিরাপত্তা না, নিরাপত্তাকর্মীদের লিফট আটকে গেলে কী করতে হবে, জেনারেটর চালু-বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়। সেগুলোও আমরা শিখিয়ে থাকি।’
শরীফুল আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সাড়ে সাতশর বেশি নিরাপত্তাকর্মী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই যাবতীয় আইনি প্রক্রিয়া মেনে ব্যবসা করে না, তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকে না। সেবার মানের ক্ষেত্রে মাত্র ৩০-৪০টা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে যারা আইনি প্রক্রিয়া মেনে কাজ করে। যারা সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া মেনে কাজ করে, তাদের কর্মীরা যেমন প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তা দিতে পারে, তেমনি নিজেকেও।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন