২০১১ সালের মার্চে যখন সিরিয়ায় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রথম গণজাগরণ শুরু হয়, সিরিয়ার অনেকাংশের উপর বাশার আল-আসাদ তখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। সাত বছর যাবত চলে আসা গৃহযুদ্ধের প্রথম তিন বছরে সরকার বিরোধীরা সিরিয়ার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। কিন্তু পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধে আসাদের পক্ষে রাশিয়া এবং ইরানের ভূমিকা যুদ্ধের গতিবিধিতে খানিক পরিবর্তন এনে দেয়।
গতবছর নভেম্বরে বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার রাশিয়া সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সাত বছরের চলমান গৃহযুদ্ধে তার পাশে থাকার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান।
মস্কোতে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন,
‘আমি তার কাছে (পুতিন) কৃতজ্ঞ এবং একই সাথে রাশিয়ার জনগণের প্রতি। তারা আমাদের দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।’
২০১১ সালের আরব বসন্তের ছোঁয়ায অন্যান্য স্বৈরাচার শাসিত আরব দেশেগুলোর মত সিরিয়াতেও সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু জনগনের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সিরিয়ার সরকার সামরিক প্রক্রিয়ায় নিষ্ঠুরভাবে দমন করার প্রচেষ্টা চালায়। ফলে, সরকারী বাহিনীর আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্য সরকার বিরোধী পক্ষগুলো একত্র হয়ে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার চার মাস পর ফ্রি সিরিয়ান আর্মি গঠন করে।
২০১১ সালের জুলাই মাসে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি গঠিত হলে তারা নিজেদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সরকারী বাহিনীর হাত থেকে সুরক্ষা প্রদানের প্রয়াস চালায়।
আমেরিকা এবং কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্র সিরিয়ার এই গৃহযুদ্ধে ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে যৎসামান্য কিছু সহায়তা দান করেছিলো।
কিন্তু বিরোধীদের রাজনৈতিক জোট সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল একজন সর্বগ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়। যিনি বিভিন্ন বিরোধী পক্ষসমূহকে একত্রে নিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে নেতৃত্ব প্রদান করে বিপ্লবকে সংহত করতে সক্ষম হবেন।
সরকার বিরোধীদের মতে, সিরিয়ার সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ বিরোধীপক্ষের সর্বগ্রহণযোগ্য কিছু নেতৃত্বকে পূর্বেই হত্যা করতে সক্ষম হয়।
ইসতিনিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মেসুত হাক্কি জাসিন বলেন,
আসাদের পতনের ফলে পশ্চিমারা ভয় পেয়ে যায়। তারা ভাবছিলো সিরিয়ার অবস্থা সাদ্দাম পরবর্তী ইরাকের রূপ ধারণ করতে পারে। আসাদ সফলভাবে এই বার্তা দিতে সক্ষম হন যে, তার পতনের ফলে সিরিয়ার অবস্থা অনিয়ন্ত্রিত এবং অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।
এছাড়া সাত বছরের গৃহযুদ্ধে আসাদ তার প্রভাব বজায় রাখার স্বার্থে রাষ্ট্রের সরকারী কর্মচারীদের বেতন নিয়মিত রেখেছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে তিনি জরুরী নাগরিক সুবিধা সমূহ যথা পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সংযোগ প্রভৃতি ঠিক রেখেছেন। এমনকি সরকার বিরোধী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলেও তা বজায় রেখেছিলেন। সিরিয়ার উপর প্রভাব ধরে রাখতে তার এই কর্মকান্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ্পালন করে।
যদিও সিরিয়ার বিক্ষোভ শুরু হওয়ার সময় এর মধ্যে কোনো মাযহাবগত পার্থক্যের বিষয় ছিলো না, কিন্তু গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যে তা মাযহাবগত পার্থক্যে রূপ নেয়।
সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ সিরিয়ায় শাসিত হয়ে আসছিলো সংখ্যালঘু আলাভি শাসকদের দ্বারা। আসাদ পরিবার সিরিয়ায় সর্বদাই সাম্প্রদায়িক বিরোধকে লালনপালন করে আসছিলো। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই আসাদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষরত বিভিন্ন পক্ষসমূহের বিপরীতে আসাদকে বিভিন্ন শিয়া সশস্ত্র সংগঠন এবং ইরান সহায়তা প্রদান করা শুরু করে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ কিল অর্টন বলেন,
‘লেবাননের হিযবুল্লাহকে সাহায্য সরবরাহের সংযোগ ঠিক রাখার স্বার্থেই ইরান আসাদকে সহায়তা প্রদান করে।’
হিযবুল্লাহ লেবাননের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগঠন, যেটি ইরানের সহায়তায় পরিচালিত হয়।
এছাড়া সিরিয়ায় আসাদের পক্ষে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি রাশিয়া। ২০১৫ সালে তারা প্র্রথম সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করে। দায়েশের সন্ত্রাস দমনের নামে তারা সরকার বিরোধী বাহিনীর উপরও হামলা চালায়।
অর্টনের মতে, সিরিয়া রাশিয়ার জন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয় ছিলো। সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি বিশ্বশক্তি হিসেবে তাদের প্রভাবকে বজায় রাখার স্বার্থেই প্রয়োজনীয় ছিলো।
রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর থেকেই সিরিয়ায় বিভিন্ন সরকারবিরোধী স্থানগুলোর উপর আসাদের নিয়ন্ত্রণ নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পায়।
বিক্ষোভ শুরু হওয়ার কিছু দিন পরেই সিরিয়ার বিভিন্ন কারাগারে আটক থাকা আল কায়েদার সদস্যদের আসাদ ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে এরাই সিরিয়ায় আল-নুসরা এবং দায়েশের মত সংগঠনের জন্ম দিয়ে সিরিয়ায় চরম অস্থিরতার সূচনা করে।
তখন আমেরিকা, রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের সকলেরেই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় দায়েশ। দায়েশকে উৎখাত করতে তারা সিরিয়ার মূল সংকট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
ইরান এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বজায় রাখার স্বার্থে আসাদকে সহায়তা করে যায়।
দায়েশ থেকে নিজেদের সীমা্ন্ত সুরক্ষার স্বার্থে সিরিয়ার সরকার বিরোধীদের সমর্থক তুরস্ক তাদের সীমান্তে মনোযোগী হয়ে উঠে।
এছাড়া দায়েশকে মোকাবেলার জন্য আমেরিকার তুরস্কের সাথে ত্রিশ বছর যাবত সংঘর্ষরত কুর্দি সশস্ত্র সংগঠন ওয়াইপিজিকে সহায়তা দিলে তুরস্ক তার সীমান্তের নিরাপত্তা সম্পর্কে আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ফলে, একইসাথে দায়েশ ও ওয়াইপিজিকে দমনের স্বার্থে তুরস্ক ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সাথে যৌথভাবে সিরিয়ার সংঘর্ষে প্রবেশ করে।
সাত বছর যাবত চলে আসা এই গৃহযুদ্ধের একটি মাত্র ফল এখনো পর্যন্ত স্পষ্ট, অন্যের সাহায্যে হলেও বাশার আল আসাদ সিরিয়ার ক্ষমতায় টিকে আছেন। আরব বসন্তের অন্যান্য স্বৈরশাসকরা যেখানে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেখানে আসাদ এখনো বহাল তবিয়তে সিরিয়া শাসন করছেন। তিনি এমন একটি গৃহযুদ্ধে টিকে যেতে সক্ষম হয়েছেন, যে গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছে এবং বাস্তুহারা হয়েছে বারো মিলিয়ন মানুষ।
(সংক্ষেপিত)
উৎস : দ্যাজবান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন