দিল্লির সাথে চলমান ‘ছায়াযুদ্ধে’র অংশ হিসেবে ইসলামাবাদ ‘পরিকল্পিতভাবে’ ভারতে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী পাঠাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত। তার দাবি, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে অস্থির রাখতে চীনের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের ওই এলাকার দিকে ঠেলে দিচ্ছে পাকিস্তান। জেনারেল রাওয়াত গত বুধবার দিল্লিতে এক সেমিনারে এ কথা বলেন। তার এই বক্তব্যের পর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে কলকাতাভিত্তিক আনন্দবাজার পত্রিকায় শুক্রবার অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিকারের সীমাটা লঙ্ঘন করা স্বাস্থ্যকর নয় শীর্ষ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তা তুলে ধরা হলো
সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক পরিসরে নাক গলালে ফলাফল যে ইতিবাচক হয় না, ভারতের পশ্চিমের ও পূর্বের প্রতিবেশীরা তার সাক্ষ্য বহন করছে। আর সশস্ত্র বাহিনী এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে এবং নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্ণণরেখাটার কথা খেয়াল রাখলে আশপাশের প্রতিকূলতা যে সুসংহত রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না, ভারত তার সাক্ষ্য বহন করছে। ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়ত কি সে সত্য উপলব্ধি করেছেন? সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ তৈরি হচ্ছে।
একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র। কত দিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বহাল থাকবে, আদৌ একটানা বহাল থাকবে কি না, সে বিষয়ে সম্ভবত খুব নিশ্চিতও থাকতে পারে না ভারতের এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সামরিক বাহিনীর অস্বাভাবিক প্রভাব এবং সাংবিধানিক সীমারেখা লঙ্ঘন করে যাওয়ার প্রবণতাই এই অনিশ্চয়তার কারণ। কিন্তু এই দুই দেশের মাঝে ভারতের ছবিটা বরাবরই অন্য রকম থেকেছে। দিন যত গেছে, ভারতে গণতন্ত্রের ভিত ততই মজবুত হয়েছে। গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সযত্নে রক্ষা করার স্বার্থে সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরস্পরের পরিপূরক হয়েছে এ দেশে। কিন্তু সামরিক বাহিনী আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে নিজেদের এক্তিয়ার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ভারতে, সেই ধারণায় জোর ধাক্কা দিয়ে দিলেন জেনারেল বিপিন রাওয়ত। অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ) নামের একটি রাজনৈতিক দল সম্পর্কে যে মন্তব্য সেনাপ্রধান রাওয়ত করলেন, তাতে দশকের পর দশক ধরে সযত্নে লালিত লক্ষ্ণণরেখাটা খুব দৃষ্টিকটূ ভাবে লঙ্ঘিত হল।
এআইইউডিএফ দলটির জনভিত্তি কী ভাবে বেড়েছে, কতটা অস্বাভাবিক গতিতে বেড়েছে, আসামের জনবিন্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক রয়েছে, দেশের নিরাপত্তা এতে কী ভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে— বিশ্লেষণ করেছেন ভারতের সেনাপ্রধান। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করার অধিকার সেনাপ্রধানের নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু সংবিধান সম্মতভাবে গঠিত এবং নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত একটি রাজনৈতিক দলের প্রসার দেশের নিরাপত্তার পক্ষে ইতিবাচক, না নেতিবাচক, তা বিচার করার অধিকার সামরিক বাহিনীর প্রধানের নেই। অন্য যে দেশেই থাক, ভারতে অন্তত নেই।
বিতর্কিত মন্তব্য আগেও করেছেন জেনারেল বিপিন রাওয়ত। কখনো তার মন্তব্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অপ্রস্তুতে ফেলেছে, কখনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বস্তির কারণ হয়েছেন তিনি, এ বার তিনি যে মন্তব্য করলেন, তা ভারতের গোটা গণতান্ত্রিক কাঠামোটার জন্য অস্বস্তিকর।
জেনারেল বিপিন রাওয়ত যে নিজের এক্তিয়ার ছাড়িয়ে গিয়েছেন, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তিনি না বুঝে সীমাটা লঙ্ঘন করলেন, নাকি বুঝেশুনেই এমন মন্তব্য করলেন, প্রশ্ন তা নিয়েই।
যদি না বুঝে এই মন্তব্য করে থাকেন জেনারেল রাওয়ত, তাহলে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অত্যন্ত দায়িত্বশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি পদের অধিকারী এখন তিনি। এত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেও কেউ যদি বুঝতে না পারেন যে, কোন মন্তব্য উচিত এবং কোনটা অনুচিত, তাহলে পদাসীন হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়।
আর জেনারেল বিপিন রাওয়ত যদি বুঝেশুনেই করে থাকেন অনাকাঙ্খিত মন্তব্যটা, যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে নিজের অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে থাকেন, তাহলে বিপদ আরো বেশি। সামরিক বাহিনীর কর্তারা কখনো এ দেশে নিজেদের সাংবিধানিক অধিকারের বাইরে গিয়ে সক্রিয়তা দেখানোর চেষ্টা করেননি। জেনারেল রাওয়তের এই আচরণ অতএব নজিরবিহীন। শুধু নজিরবিহীনই নয়, সেনাপ্রধানের এই অতি সক্রিয়তা গণতন্ত্রের পক্ষে কোনো সুলক্ষণও নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন