যেসব মুসলিম নারীরা তাদের মাথায় হিজাব ও গোমটা পরা নিয়ে লড়াই করছেন তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে ১ ফেব্রুয়ারি এক দিনের জন্য বিশ্বব্যাপী সকল ধর্ম ও জাতিগত পটভূমির নারীরা এক বৈশ্বিক আন্দোলনে যোগ দেন।
বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত ‘বিশ্ব হিজাব দিবস’ (ডাব্লিউএইচডি) উপলক্ষ্যে তারা এতে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সাল থেকে একটি বৈশ্বিক আন্দোলন হিসেবে প্রতি বছর এটি পালিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক নাজমা খান বিশ্ব হিজাব দিবসের প্রচলন করেন। ১১ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন। হিজাবের পরার কারণে তিনি হাই স্কুল ও কলেজ জীবন থেকে ক্রমাগতভাবে বৈষম্য এবং মৌখিক হয়রানির বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
ডাব্লিউএইচডি প্রতিষ্ঠা তার মতো নারী ও মেয়েদের প্রতি আরো বেশি সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের পথ তৈরি করে দিয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠার জন্য তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে মুসলিম নারীরা যাতে নির্বিঘ্নে প্রতিদিন হিজাব পরিধান করতে পারেন সে সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে। সেখানে ‘#স্ট্রং ইন হিজাব এবং #ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে’র মতো হ্যাশট্যাগেরও প্রতিযোগিতা চলেছে। অংশগ্রহণকারীরা তাদের সম্পূর্ণভাবে বা আংশিক আচ্ছাদিত করার অভিজ্ঞতাকে প্রশংসা করেছেন। অন্যদিকে, বিরোধিরা এই অনুষ্ঠান পালনের বিরোধিতা করেন এবং ইরানের নারীদের ‘পোশাক কোড’ নীতির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বিক্ষোভের বিষয়টি উল্লেখ করে এর কঠোর সমালোচনা করেন।
ডাব্লিউএইচডি হিজাবকে আধুনিক পোশাক হিসেবে দেখছে। একই সময়ে এটিকে অগ্রাহ্য করে কিছু নারী এর বিরোধিতা করছেন।
পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, পছন্দের একটি প্রশ্ন হিসাবে মুসলমান নারীদের হিজাবের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ। যখন কিছু নারী তাদের হিজাব পরার অধিকারের জন্য লড়াই করছেন, তখন অন্যরা এটি না পরার তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন।
যাইহোক, উভয় ক্ষেত্রেই নারী সংস্থাগুলো একটি বৃত্তের মধ্যে বন্দী হয়ে গেছেন এবং আমাদের এটা স্বীকার করা উচিত যে, পছন্দের স্বাধীনতার জন্য সমর্থন যেন একমুখী না হয়। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়াই করতে গিয়ে হিজাব পরিধান করার অধিকারকে বিরোধিতা করা কিংবা এর উল্টোটা হলে তা হবে এক প্রকার ভণ্ডামি।
কিন্তু, ডব্লিউএইচডিতে যোগদানের জন্য এবং তার প্রাথমিক বার্তাটি শেয়ার করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় যথারীতি আমিও আমন্ত্রণ পেয়েছি। হিজাব সম্পর্কে মতপার্থক্য এবং মুসলিম ও অমুসলিম নারীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংহতি বৃদ্ধি আমাকে গভীর ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এই ধরনের ইভেন্টসমূহ তাদের মিশনে কতটা সফল হতে পারবে?
দৃঢ়-সংকল্প যদি একটি সাধারণ স্বার্থ হয় যে পৃথিবীর সব নারীরা লড়াই করতে চায়, সেইক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের জন্য ‘হিজাব একটি শোষণ বা সেকেলে- এই সংজ্ঞায় ডব্লিউএইচডি’র অংশগ্রহণকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে।
ইসলামোফোবিয়া হিজাবি নারীদের জন্য বাস্তবিক অর্থে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। একদিনের জন্য হিজাবকে ধারন করার মাধ্যমে একজন অমুসলিম নারী তার সামাজিক সার্কেলকে শিক্ষিত করতে পারে; যেখানে মুসলিম নারীরা সাধারণত উপস্থিত হতে পারে না। হিজাবকে একজন নারীর জন্য একটি বাধা হিসেবে দেখা উচিৎ নয়।
এছাড়াও, ডাব্লিউএইচডি’র অংশগ্রহণকারীরা এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারে যে, হিজাব হচ্ছে পোশাকের একটি রীতি। এটি কিছু নির্দিষ্ট এলাকা বা সময়ের সঙ্গে আবদ্ধ হওয়া উচিত নয়।
পোশাকের একটি অংশ হিসেবে ২১ শতকের যে কোনো দেশের নারীদের হিজাব বেছে নেওয়ার জন্য স্বাধীনতা থাকা উচিত এবং এটি তার সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত। হিজাব পরিত্যাগের জন্য তাকে বাধ্য করা- এমন একটি আরোপের মতো- যে কোনো নারীকে এক টুকরো কাপড় পরতে বাধ্য করা-যেটিতে তিনি অস্বস্তিবোধ করেন। এইভাবে শারীরিকভাবে অখণ্ডতার জন্য হিজাব হচ্ছে নারীর অধিকারের অংশ।
ইউরোপে ইসলামোফোবিয়া সম্পর্কিত গবেষণায় দেখা গেছে, মুসলিম নারীরা বিশেষত প্রত্যাহিক ভিত্তিতে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন এবং শ্রম বাজারে তাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে। মুসলিম পুরুষদের তুলনায় মুসলিম নারীরা অধিক হারে মৌখিক নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এমনকি যেসব মুসলিম নারীরা হিজাব পরেন না তারাও এ থেকে রেহায় পাচ্ছেন না।
কোনো সন্দেহ নেই যে বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ডব্লিউএইচডি’র একটি ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তবে ইসলামোফোবিয়া প্রায়ই দৃঢ়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে যেটি আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে এবং এর জন্য টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
একারণেই এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া অমুসলিম নারীদের একদিনের অভিজ্ঞতা ‘ক্ষমতায়নের’ হাতিয়ার হতে পারে। এই অভিজ্ঞতা অন্যান্য বিষয় যেমন-জাতি এবং জাতিগত হিসাবে, সামাজিক শ্রেণি হিসেবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে আবদ্ধ।
লেখক পরিচিতি: লিন্ডা হ্যাকি ইসলাম এন্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স সেন্টারের একজন গবেষণা সহকারী এবং সিভিলাইজেন ইনস্টিটিউটের একজন পিএইচডি প্রার্থী।
ডেইলি সাবাহ অবলম্বনে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন