দিল মোহাম্মদ (৫২), মিয়ানমারের ঠেকিবনিয়া থানার মিদি গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় দুই দশক কাজ করছেন দেশটির দোভাষী হয়ে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের এমন কোনো কূটনৈতিক বৈঠক নেই, যেখানে তার ডাক পড়েনি। দিল মোহাম্মদকে তো মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী- সবাই প্রিয় বন্ধু বলে পরিচয় করাতো। তিনিও এই পরিচয়কে বহন করতেন, দেশের স্বার্থরক্ষায় কাজ করতেন।
বাংলা ভাষাকে সহজবোধ্য করার জন্য এমনও হয়েছে, দিল মোহাম্মদ নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হতে না পারলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ওই বৈঠকের সময়ই বদলে দিয়েছে। এভাবেই বিগত ২০ বছরে নিজ দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করেছেন দিল মোহাম্মদ। বিশ্বাস ঘাতকতা দূরে থাক, কখনও মাতৃভূমির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে পারে, এমন কল্পনাও করেননি তিনি। দেশের স্পর্শকাতর তথ্য তার কাছ থেকে আজঅব্দি কেউ নিতে পারেনি।
অথচ রোহিঙ্গা মুসলিম হওয়ায় গতবছরের আগস্টের ঘটনার পর দিল মোহাম্মদকেও ছুড়ে ফেলে দিয়েছে মিয়ানমার। তার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। হত্যা করার জন্য হুলিয়া দিয়েছে। কালো তালিকাভুক্ত করে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েছে।
কোনো রকম প্রাণে বেঁচে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে সীমান্তের জিরো পয়েন্টে। তার ভাষ্যে, প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে কোথাও যেতে মন সাই দেয় না। তাইতো নিজ মাটির গন্ধ পেতে কাছাকাছি রয়েছি।
সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান নিয়ে দিল মোহাম্মদ বিগত ৭ মাস ধরে ক্ষণ গুণছেন নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার। এত নিষ্ঠুরতার পরও দেশের মায়া কাটাতে পারছেন না তিনি।
এখনও সীমান্তের কাঁটা তারের ভেতরে মিয়ানমার বাহিনীর কোনো সদস্য পেলেই দিল মোহাম্মদ আকুতি জানাচ্ছেন তাদের ফিরিয়ে নেয়ার, বসবাসের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করার।
বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে কান্নাজড়িত কণ্ঠে দিল মোহাম্মদ পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আমি মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সঙ্গে দেশের উন্নয়নে ২০ ধরে কাজ করেছি। এই সময়ে ৫০ বারের মত মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করেছি। কিন্তু, এখন আমাকেও দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে।’
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘যে আমি মিয়ানমার সেনাদের প্রিয় ব্যক্তি ছিলাম, তারাই কিনা এখন আমাকে বাঙালি আখ্যা দিয়ে হত্যার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে।’
রোহিঙ্গা মুসলিম হওয়ার কারণেই নিজেকে শরণার্থী হতে হয়েছে বলেও জানান দিল মোহাম্মদ।
চরম এই সংকটে বাংলাদেশ যে ভূমিকা নিয়ে তার প্রশংসা করেন তিনি। বলেন, ‘বাংলাদেশ যা করেছে, তাতেই আমরা কৃতজ্ঞ। এখন বিশ্ববাসীকে নিয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপর আরও চাপ তৈরি করতে হবে।’
মিয়ানমারে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত না হলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আত্মঘাতী হবে বলেও মনে করেন দিল মোহাম্মদ।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন আর মিয়ানমার সরকারকে বিশ্বাস করি না। কিভাবে চোখের সামনে প্রিয় মানুষগুলোকে তারা নিষ্ঠুরভাবে খুন করল, ভাবতেই অবাক লাগে। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে দীর্ঘ ২০ বছরের সম্পর্ক ভুলে তারা আমাকে শত্রু বানিয়ে হত্যা করতে চাইছে।’
মিয়ানমারের এই দোভাষী নিজ দেশের রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করে তাদের নিরাপদে দ্রুত ফেরত নেয়ার দাবি জানান।
গত বছরের আগস্টের শেষ দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর জাতিগত নিধন চালায়। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে থাকে। ইতোমধ্যে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছে।
এসব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে গতবছরের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি করে। চুক্তিতে দুই মাসের মাথায় প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফেরত যেতে পারেননি। উল্টো আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে।
এদিকে, এসব রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে নতুন-পুরাতন মিলে ১০ লাখ ৬৫ হাজার ৭৩৬ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন