‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার অপরাধের জন্য পোলিশ ও অন্যান্যদের মতো ইহুদিরাও দায়ী’ পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেইস মোরাউইস্কির এমন বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। হলোকাস্ট বিষয়ক একটি নতুন আইন করার পর থেকেই সমালোচনার মুখে রয়েছে ওয়ারশ।
চলতি মাসেই পোল্যান্ড একটি নতুন আইন পাশ করে, যাতে ‘পোল্যান্ডও হলোকাস্টের সহযোগী ছিলো’ বলার জন্য কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এর তীব্র সমালোচনা করেছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র।
এই আইনের অধীনে, জার্মান থার্ড রাইখের (হিটলারের আমলের জার্মানি এ নামেই পরিচিত ছিল) করা কোন অপরাধের জন্য পোলিশ জাতি বা রাষ্ট্রকে দায়ী বলা হলে, যে কেউ অর্থ দণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।
চলতি বছরের মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স বসে ১৬ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি। এ কনফারেন্সে রিপোর্টার রোনেন বার্গম্যান পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, পোল্যান্ডে হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া তার মায়ের জীবনের গল্প বললে বা কয়েকজন পোলিশ গেস্টাপোদের সহযোগিতা করেছিলো. এমনটি বললে নতুন আইনে তিনি নিজেও দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন কিনা?
এর উত্তরে মোরাউইস্কি বলেন, “অবশ্যই এটা দণ্ডযোগ্য হবে না, অপরাধ হিসেবে দেখা হবে না, যদি বলা হয় শুধুমাত্র জার্মান অপরাধীই নয়, সেখানে পোলিশ অপরাধী ছিলো এবং ছিলো ইহুদি অপরাধী, রাশিয়ান অপরাধী, ইউক্রেনিয়ান অপরাধী।”
নেতানিয়াহু, নিজেও ওই মিউনিখ কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন। তিনি পোলিশ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, “পোলিশ প্রধানমন্ত্রী মিউনিখে যে বক্তব্যটি দিলেন তা ভয়ঙ্কর। এখানে ইতিহাস অনুধাবনে তার সক্ষমতায় সমস্যা রয়েছে। আমাদের লোকদের দুর্দশার প্রতি সংবেদনশীলতারও অভাব রয়েছে। আমি দ্রুতই এ ব্যাপারে তার সাথে কথা বলবো।”।
ইসরায়েলের অন্যান্য কর্মকর্তারাও পোলিশ আইনটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মোরাউইস্কির মন্তব্যেরও বিরোধিতা করেছেন তারা।
ইসরায়েলের কর্মকর্তা
ইসরাইলের আইনপ্রণেতা ইয়ার ল্যাপিড টুইটারে লিখেন, পোলিশ প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি সেকেলে ধরনের ইহুদি বিদ্বেষ। অপরাধীরা ক্ষতিগ্রস্থ নয়। হত্যার শিকার হওয়াদের নিজেদের হত্যার জন্য দায়ী করার অপচেষ্টার অনুমোদন দেবে না ইহুদি রাষ্ট্র। পোল্যান্ডে ইসরাইলের অ্যাম্বেসেডরকে ডেকে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
যুদ্ধ পূর্ববর্তী পোল্যান্ডে বসবাস করা ৩০ লাখ ইহুদি নাৎসিদের হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলো। হলোকাস্টে নিহত হওয়া সকল ইহুদিদের তুলনায় এই সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এডলফ হিটলারের অধীনস্থ নাৎসি সামরিক বাহিনী পরিচালিত গণহত্যায় আনুমানিক ষাট লক্ষ ইহুদি এবং আরও অনেক সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ প্রাণ হারায়।
পোল্যান্ডে দখলদার ইহুদিদের নির্মিত ও পরিচালিত ডেথ ক্যাম্পগুলোতে এই অঞ্চল জুড়ে বসবাস করা ইহুদিদের নিয়ে হত্যা করা হতো। পোল্যান্ড তখন ছিলো ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য ইউরোপের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল- এর মধ্যে রয়েছে অসউইচ, ত্রেবলিন্কা, বেলজেক এবং সোবিবর।
হাজারো পোলিশ তাদের ইহুদি প্রতিবেশীদের রক্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলো। কিন্তু ১৯৮৯ সালে কমিউনিজম এর পতনের পর প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পোলিশরা হাজারো ইহুদিদের হত্যাও করেছে বা নাৎসি দখলদারীদের ভয়ে পালিয়ে থাকাদের সাথে খারাপ আচরণ করেছে। এই বক্তব্যটি দেশটির জাতীয় বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় যে, ‘পোল্যান্ড শুধুই ক্ষতিগ্রস্থ ছিলো’।
টুইটারে জবাব
ইউএস হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ডে হামলা চালানো নাৎসিরা কমপক্ষে ১৯ লাখ অ-ইহুদি পোলিশ সাধারণ জনগণকে হত্যা করে।
কনফারেন্সে উপস্থিত কয়েকজন পরবর্তী সময়ে টুইটারে পোলিশ প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের নিন্দা জানান। প্রতিবেদক বার্গমান নিজেও টুইটে পোলিশ প্রধানমন্ত্রীর জবাবকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলে অভিহিত করেন। লন্ডন ভিত্তিক কূটনীতি বিশেষজ্ঞ ফ্র্যাঙ্কয়স হেইজবার্গ বলেন, ‘পোলিশ অপরাধী থাকা মানে ইহুদি অপরাধী থাকা’ একটি ‘লজ্জাজনক জবাব’।
ইসরায়লি পত্রিকা হারেতজ এর সংবাদ দাতা নোয় ল্যান্ডাও সেই ‘ভয়ঙ্কর দৃশ্য’টির নিন্দা জানান, যেখানে মোরাউইস্কির মন্তব্যের পরও দর্শকদের নীরব থাকতে দেখা যায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন