শীতের হিম করা আবহাওয়ায় ১৫ বছর বয়সের ইফরা শাকুর ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীরের পালওয়ামায় তার বাড়িতে নীরবে বসে আছেন।
ওই ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবরের ভয়ঙ্কর দিনটির কথা মনে করার চেষ্টা করতেই তিনি ফ্যাকাশে, বিমর্ষ আর কেঁপে ওঠলেন। চোখ থেকে নেমে এলো ফোঁটা ফোঁটা পানি। এই প্রবাহ থামানোর কোনো চেষ্টাও তিনি করলেন না।
‘আমি ওই দিনটির কথা কোনো দিন ভুলব না,’ তিনি সাউথ বললেন। কথাটি তার বুকের অনেক ভেতর থেকেই বের হয়ে এলো।
২০১৬ সালে কাশ্মির ছয় মাসের বিক্ষোভে ডুবে যায়। ওই সময় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী পেলেট গুলি (ছড়ড়া গুলি) বর্ষণ করে যে ১২ শ’ কাশ্মিরিকে অন্ধ করে দিয়েছিল, আফরা তাদের একজন। ওই বছরের ৮ জুলাই ভারতীয় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গি নেতা বুরহান ওয়ানিকে হত্যা করেছিল। ওই হত্যাকাণ্ডের পর দিন থেকেই কাশ্মির বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, পরিণতিতে ২৪ ঘণ্টায় ৩০ বিক্ষোভকারী নিহত হয়।
এরপর সৃষ্ট সহিংসতায় ৯০ জনের মতো নিহত হয়, আহত হয় ১১ হাজার। কাশ্মীরের স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে কারফিউ বলবৎ ছিল। কাশ্মির উপত্যকার আধুনিক ইতিহাসে ২০১৬ সাল ছিল বৃহত্তম সময়ের অস্থিরতা।
রাজপথের বিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী বিপুল মাত্রায় পেলেট গান ব্যাবহার করে। এতে ১,২০৯ জন তাদের এক চোখের বা উভয় চোখের দৃষ্টিশক্তি হারায়। সরকারি হিসাব মতে, ৭৭ জনের উভয় চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ২১ জন এক চোখ হারিয়েছে।
এত লোক অন্ধ হওয়ার পাশাপাশি পেলেট গানের শিকার হয়ে ১৬ জন নিহত এবং ৭,০০০ জন আহত হয়েছে।
ইফরা শাকুর
২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর কয়েকটি কিশোর ইফরাদের বাড়ির সামনে থেকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে পাথর নিক্ষেপ করছিল। কৌতুহলবশত কী ঘটছে তা দেখার জন্য বাইরে বের হয়েছিল। দেখতে পেল, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তার দিকে ছুটে আসছে।
ইফরা জানান, ভয় পেয়ে আমিও দৌড় দিলাম। তারা আমাকে ধরে নির্মমভাবে টানতে লাগল, তারপর আমাকে লক্ষ্য করে পেলেট গান ছোঁড়ে।
ওই ঘটনার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়, অদ্ভূত শব্দ তার কানে বিস্ফোরিত হতে থাকে।
ইফরা তার সারা মুখে লেপ্টে থাকা নৃশংসতার কথা বলে, আমি তখন আমার কম্পিত হাত চোখে লাগাই, মনে হলো তরল কিছু বের হচ্ছে। আমি জানতাম, আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি।
ইফরার বাবা আবদুল গনি বলেন, মেয়েকে হাসপাতাল নিয়ে গেলে জানা যায়, পেলেট তার রেটিনা আর অপ্টিক নার্ভ ভেদ করে গেছে। ফলে সে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছে। দুটি সার্জারির পর সে বাম চোখে সামান্য দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে। অবশ্য আফরা জানিয়েছে, সে পড়তে বা লিখতে পারে না। ফলে পড়াশোনা চালানো তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
আফরা বলেন, আমি পত্রিকার দিকে তাকালে আবছা কিছু দেখি। কিভাবে তাকাতে হয়, তা-ও আমি ভুলে গেছি।
আচরণে পরিবর্তন
আফরার কেবল শারীরিক পরিবর্তনই হয়নি, মানসিক পরিবর্তনও হয়েছে। ওই ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তার আচরণ গেছে বদলে।
তার বাবা বলেন, সে এখন তার কক্ষে একাকী থাকতে চায়, খুব কমই সে অন্যদের তার ঘরে প্রবেশ করতে দেয়।
আবদুল গনি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, সামাজিক মেলামেশাকে সে ঘৃণা করে। এমনকি স্কুলের বন্ধুদেরও সাথেও মেশে না, সবকিছু ভেঙে ফেলে। তার আচরণ নিয়ে আমরা চিন্তিত। ভয় পাচ্ছি, সে নিজেরই না কোনো ক্ষতি করে ফেলে। আমরা তার কক্ষে ধারাল কিছু রাখি না, সবসময় তাকে নজরে নজরে রাখি।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছিল, কাশ্মিরে পেলেটে আক্রান্তদের বেশির ভাগকেই বিষন্নতা ভর করেছে। তারা উদ্বিগ্ন। তাছাড়া ট্রমার কারণে স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আক্রান্তরা মারাত্মক মানসিক সমস্যায় রয়েছে। তাদের জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে, তারা বেঁচে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, আগামী দিনগুলোতেও তারা এই আঘাত বয়ে বেড়াবে।
কাশ্মিরের প্রখ্যাত মনোবিদ ড. আরশিদ হোসাইনও বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, কাশ্মিরে আক্রান্তরা মানসিক সমস্যায় ভুগছে, তাদের মধ্যে বিষন্নতার সিনড্রোম দেখা দিয়েছে।
ড. আরশিদ বলেন, অনেক রোগীর মধ্যেই এই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, পেলেট আক্রান্তদের আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা পুরোপুরি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পেলেটের শিকার হয়ে ২৯ বছর বয়স্ক কাশ্মিরি ফটো সাংবাদিক জুহাইব মকবুল চোখ হারিয়েছেন। শ্রীনগরে ছবি তোলার সময় তিনি আক্রান্ত হন। তার চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকেরা তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখতে পেয়েছেন।
জুহাইব মকবুল
জুহাইব কেঁদে কেঁদে বলেন, আমি যখন আক্রান্ত হই, তখন সবাই ছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ পর অন্ধকারে কেবল আমিই রয়েছি। আমি ছয় মাস আমার ঘরে রয়েছি, কোথায় যাইনি।
তার পরিবার বলে, সে গভীর রাতেও বাতি জ্বালিয়ে রাখে, যাতে দুঃস্বপ্ন ভর করতে না পারে।
তিনি বলেন, দুনিয়া যত উজ্জ্বলই হোক না কেন, আমার জীবনে অন্ধকারই স্থায়ী বিষয়।
চিকিৎসার সময় জুহাইবের মনোবিদ তার মধ্যে আত্মহত্যার লক্ষণ দেখতে পেয়েছেন।
কাশ্মিরের শীর্ষস্থানীয় মনোবিদ ড. মোজাফফর তার চিকিৎসা করছেন। তিনি বলেন, জুহাইবের সব আবেগই হিমশীতল হয়ে পড়েছে।
ইনশা নামের ১৫ বছর বয়সী ৯ম শ্রেণির ছাত্রীও দুই চোখ হারিয়েছেন। ওই সময়ের বিক্ষোভকালে তিনি জানালা দিয়ে তাকিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই তিনি চির দিনের জন্য অন্ধকারে ডুবে গেছেন।
শ্রীনগর, দিল্লি ও মুম্বাইয়ে তার চোখে ছয় বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। কিন্তু কোনোটিই সফল হয়নি।
তিনি আর্তস্বরে বলেন, দু’বছর কেটে গেছে, আমার চারপাশের দুনিয়া রাতের মতো অন্ধকার দেখা যায়। আমি এখন স্পর্শ করে সবকিছুর আকার অনুভব করি, আমি রঙ ভুলে গেছি, দুনিয়ার সবকিছুই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে।
তার বাবা মোশতাক আহমদ লোন বলেন, ওই ঘটনা তার মেয়েকে শারীরিক ক্ষতির চেয়ে বেশি করেছে মানসিক ক্ষতি।
তিনি বলেন, তার সহ্যশক্তি যা-ই হোক না কেন, বাইরে থেকে তাকে যতই হাশিখুশি দেখা যাক না কেন, সে দুর্বল আর ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে।
তিনি জানান, ওই ঘটনার পর ইনশা দূরে চলে গেছে, তার আচরণে আকস্মিক পরিবর্তন এসেছে।
তিনি বলেন, সে সবসময় কিছু না কিছুতে ব্যস্ত রাখতে চায় নিজেকে। অনেক সময় নিজের সামনে বই মেলে রাখে, হাত দিয়ে পৃষ্ঠাগুলোতে হাত বোলায়। অন্ধত্ব তাকে বিষন্নতা আর উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে।
কাশ্মিরে সহিংসতা চলছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে, ব্রিটিশ শাসন অবসানে ভারত ও পাকিস্তান নামে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকে। উভয় দেশই কাশ্মির দাবি করছে, তারা এ নিয়ে তিনবার যুদ্ধ করেছে, অসংখ্যবার ছোটখাট লড়াই করেছে।
কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন চলছে, তার সূচনা হয়েছে ১৯৯০ সালে। ইতোমধ্যেই এর রেশ ধরে বেসামরিক নাগরিক, জঙ্গি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মিলিয়ে অন্তত এক লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন