ভ্যালেনটাইনের দিনতে আনুমানিক দুপুর ২টার দিকে ১৯ বছর বয়সী একজন বন্দুকধারী ফ্লোরিডার মারজোরি স্টোনম্যান ডগলাস হাই স্কুলে তার সাবেক শিক্ষক এবং সহপাঠীদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। এতে ১৭ জন নিহত এবং কয়েক ডজন গুরুতর আহত হয়। গত ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মার্কিন স্কুল ক্যাম্পাসে এটি ১৮তম হামলার ঘটনা এবং এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে সংঘঠিত ভয়াবহ বন্দুক হামলার মধ্যে এটি নবমতম স্থানে ওঠে এসেছে।
পরের দিন সকাল ৬ টায় কর্তৃপক্ষ বন্দুকধারীকে নিকোলাস ক্রুজ নামে চিহ্নিত করে এবং পূর্বপরিকল্পিত ১৭ খুনের মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য এখনো জানা যায়নি। তবে, হত্যাকারীর মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইল ইতোমধ্যে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে এবং তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুবই সাধারণ একটি বিষয়।
পরিচিত সব বৈশিষ্ট্য
এই ট্র্যাজেডির শিরোনামগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিচিত সব বৈশিষ্ট্যসমূহ: বন্দুক, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, চরম ডানপন্থীদের প্রত্যক্ষ বর্ণবাদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের মুসলিম বিদ্বেষ।
নতুন আমেরিকান দুঃস্বপ্নে সকলকে স্বাগতম।
কিলার এমন ঘটনা ঘটাতে পারে সে সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অনেক জল্পনা ছিল। সেখানে সতর্কবার্তা ছিল।
ফ্লোরিডা টেলিভিশন স্টেশনকে একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘অনেক লোক বলছিল যে সে (ক্রুজ) এটি ঘটাতে যাচ্ছে। এটি প্রত্যেকের পূর্বাভাসকে সত্যে পরিণত করেছে। এটা সত্যিই ক্রেজি।’
ক্রুজ যে এই ধরনের নিষ্ঠুরতা চালাতে সক্ষম- সে সম্পর্কে তারা কিভাবে ভবিষ্যদ্বাণী তারা করতে পেরেছিল, ছাত্রটি তা বলেনি। যাইহোক, তাদের এই ভবিষ্যদ্বাণীর কারণগুলো সম্ভবত হতে পারে যে, ক্রুজকে ক্রমাগতভাবে স্কুলটি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছিল এবং অবশেষে তাকে সেখান থেকে বহিষ্কৃত করা হয় এবং এটি সম্ভবত বন্দুক ও ছুরির প্রতি তার আগ্রহ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার পোস্ট এবং মুসলিমদের প্রতি তার ঘৃণা।
ছাত্রটি বলেছিল, ‘সামাজিক মাধ্যমে তার পোস্ট করা সব কিছুই ছিল অস্ত্র সর্ম্পকিত। এটা তার অসুস্থতা প্রকাশ করে।’
আরেকজন ছাত্র ক্রুজ সম্পর্কে জানায় যে, সে প্রায়ই ট্রাম্প ক্যাপ পরতেন এবং ইসলাম সম্পর্কে ঘৃণাসূচক লেখা সম্বলিত অতি-দেশপ্রেমিক টি-শার্ট পরতেন। এছাড়াও, মুসলিমদেরকে সন্ত্রাসী ও বোমাবাজ হিসাবে উপহাস করার জন্যও ক্রুজ পরিচিত ছিল।
বৃহস্পতিবার ফ্লোরিডার রিপাবলিক প্রতিনিধি ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাধী গ্রুপের নেতা- যার লক্ষ্য হল ফ্লোরিডাকে শুধুই শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত রাজ্য বানানো। তিনি বলেন, ক্রুজ তাদের আধা-সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছিল এবং সে তাদের একজন সদস্যে পরিণত হয়েছিল এবং হামলায় ব্যবহৃত তার কেনা ‘এআর -১৫’ রাইফেলটি তাদের গ্রুপটি থেকে কেনা হয়েছিল বলে তিনি স্বীকার করেন।
ইসলামোফোবিয়া এবং বন্দুক সংস্কৃতি
এই প্রবন্ধ মুসলিম বা অন্য কোনো সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের জন্য ক্রুজের প্রকাশকে কোনোভাবেই দোষারোপ করে না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ এখনো এই হত্যার মোটিভ উদ্ধার করতে পারেনি। যাইহোক, ভয়াবহ এই ট্র্যাজেডি-পরবর্তী বিভিন্ন বিশ্লেষণে কঠোর বন্দুক আইন এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা খতিয়ে দেখার দাবি ওঠেছে। এই নিবন্ধে জনপ্রিয় মতকে কিভাবে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে তা নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে ইসলামোফোবিয়া ও বন্দুক সংস্কৃতির মধ্যে অন্তর্চ্ছেদকে তুলে ধরা হয়েছে।
আমেরিকার উচ্চ শক্তিধর অস্ত্রের জন্য বিকৃত লালসা মুসলিম ঘৃণার পিছনে কাজ করছে এবং ক্ষমতাশালী ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) দেশটির ৩.৫ মিলিয়নের আমেরিকান মুসলমানদের প্রতি ক্রমবর্ধমানভাবে বিদ্বেষকে উসকে দিচ্ছে।
এনআরএ -এর ২০১৫ জাতীয় বার্ষিক সম্মেলনের একটি সেশনে সদস্যদেরকে কিছু নিদের্শনা দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল-ইসলামিক চরমপন্থীরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ইসলামিক আইন প্রণয়ন করে, সেই ক্ষেত্রে সদস্যদের কি করতে হবে তার নির্দেশনা। এটিকে আমেরিকান বন্দুক মালিকদের জন্য প্রকৃত হুমকি বলে অভিহিত করা হয়েছিল।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপক শ্রোতাদের জানান যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন এলাকায় ছিলেন যেখানে কেবল মুসলিমদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি দাবি করেন, এটি এমন এলাকা যেখানে পুলিশও প্রবেশ করতে অস্বীকার করে।
তিনি উপস্থিত সদস্যদের উদ্দেশ্য বলেছিলেন, ‘রাস্তার চিহ্নগুলো রাতারাতি ইংরেজি থেকে আরবিতে রুপান্তরিত হয়ে যায়। কোনো দোকান বা রাস্তার কোনো চিহ্নে একটি ইংরেজি শব্দও ছিল না।এটা আমি আমার নিজের চোখে দেখেছি এবং এটিই বাস্তব।’ তিনি আরো দাবি করেন যে, সেখানে ৫ হাজারেরও বেশি জানা সন্ত্রাসী রয়েছে।
পরে ডানপন্থী ‘ফক্স নিউজ’ সহ মার্কিন গণমাধ্যমের খবরে স্বীকার করা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দিষ্ট এলাকায় শুধুমাত্র ধর্মের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিরা থাকেন- এমন বিবৃতিকে সমর্থন করার বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
কিন্তু আসল সত্য উৎঘাটন হোক বা না হোক, এই মুসলিম বিরোধী ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো কেবল সত্য হিসাবেই গ্রহণ করাই হয় নি, বরং এটি মিডিয়ার মাধ্যমেও অতি রঞ্জিত করে তোলা হয়। যারা মুসলমানদের সম্পর্কে ভয়, ঘৃণা এবং সন্দেহের গুজব ছড়ায়, zএটি ছিল তাদের জন্য এক ধরনের পুরস্কার।
শ্বেতাঙ্গদের বড় ধরনের মিলিশিয়া কার্যকলাপ
মানবাধিকার গ্রুপ ‘হেইট হার্টস’ এর প্রতিষ্ঠাতা ইমরান সিদ্দিকী আমাকে বলেন, ‘যদিও এই বিষয়ে খুব সামান্যই কভারেজ রয়েছে। এটা খুব কমই বিস্ময়কর যে বেশিরভাগ মুসলিম বিরোধী রাজ্যগুলোতে ব্যাপক মিলিশিয়া কার্যকলাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত বন্দুকের সংস্কৃতি বিরাজ করছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বন্দুক-সংস্কৃতি এবং ইসলামোফোবিয়ার মধ্যে যে অন্তর্চ্ছেদ রয়েছে তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ হিসাবে আমরা ফিনিক্স, অ্যারিজোনার সশস্ত্র মসজিদ প্রতিরক্ষাকে ফিরে দেখতে পারি। মিলিশিয়া সদস্যরা মসজিদের বাইরে এরআর-১৫ এবং অন্যান্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।’
ইমরান সিদ্দিকী বলেন, ‘এই ধরনের পদক্ষেপসমূহ টেক্সাস, সাউথ ডাকোটা, ক্যানসাসের মতো জায়গায় বিদ্যমান রয়েছে। এটা ভুলে যাওয়ার নয় যে ট্রাম্পের সমর্থক শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের মিলিশিয়া গ্রুপটি ২০১৬ সালে সোমালি সম্প্রদায়ের ওপর বোমা হামলার চেষ্টা করেছিল।’
একজন সুপরিচিত আমেরিকান মুসলিম পন্ডিত ও ইয়াকিন ইনস্টিটিউট ফর ইসলামি রিসার্চের প্রেসিডেন্ট উমর সুলেইমান এক সাক্ষাতকারে আমাকে বলেন, ‘সশস্ত্র সদস্যরা মুখোশের আড়ালে শুয়োরের রক্তে তাদের বুলেট ডুবিয়ে দিচ্ছে। এটি এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা একদিন আমাদের সব মুসলমানদেরকে গুলি করতে যাচ্ছে।’
যে শেষ পর্যন্ত আমরা ক্রুজের এই নিষ্ঠুর সহিংস আচরণের একটি পরিষ্কার ধারণা পাব বলে আশা করছি। এটি লক্ষ্যনীয় যে, শ্বেতাঙ্গ মিলিশিয়াদের হাতে হত্যার সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘এন্টি ডিফ্যামেশন লীগ’ এর একটি প্রতিবেদনে এই তথ্য ওঠে এসেছে।
বন্দুকের সহজলভ্যতা ঘৃণা অপরাধকে বৃদ্ধি করেছে। এই সহজ লভ্যতা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রর ইঙ্গিত দেয়। নতুন আমেরিকান দুঃস্বপ্নে স্বাগতম।
লেখক: সি জে ওয়ারলেম্যান ‘ক্রাসিফাইফিং আমেরিকা (২০১৩), কোরআন কৌতুহুল (২০১১) এর লেখক। টুইটারে তাকে অনুসরণ করুন @cjwerleman
মিডল ইস্ট আই অবলম্বনে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন