বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘মূলত রাজনৈতিক কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পরস্পরের কাছে আসতে পারছে না। অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারকে মাথায় রেখে আমরা কোনো উদ্যোগ নিলে তাতে দেখা যায় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ভেটো দেয়। বাণিজ্য, যোগাযোগসহ নানা প্রস্তাবে এভাবেই নিরাপত্তার প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাছাড়া আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের স্বার্থের বিষয়টি দেশগুলোকে মাথায় রাখতে হচ্ছে।’
শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম আয়োজিত তৃতীয় বার্ষিক অর্থনীতিবিদদের সম্মেলনের প্যানেল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
রেহমান সোবহান বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় সে অর্থে কোনো শক্তিশালী ভ্যালু চেইন গড়ে ওঠেনি। কার্যকর ভ্যালু চেইন গড়ে তুলতে হলে দেশগুলোর মধ্যে কাঠামোগত সমতা আনতে হবে। কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এমনটা করতে পেরেছে। কিন্তু আমরা তা থেকে শিক্ষা নিইনি। ৩৬ বছর বয়স যখন আমার তখন (১৯৭২ সালে) আমি বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে ভারতের সঙ্গে সমঝোতায় বসেছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, আসাম থেকে লাইমস্টোন এনে বাংলাদেশে সিমেন্ট তৈরির কথা, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো থেকে আকরিক এনে বাংলাদেশে স্টিল শিল্প স্থাপনের কথা, আর ইউরিয়া সারের কারখানা স্থাপন করে তা ভারতে রপ্তানি করার কথা।’
অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। সেটি সে সময় হলে বাংলাদেশ-ভারত একটি যৌথ ও সমন্বিত ভ্যালু চেইনের মধ্যে সম্পৃক্ত থাকতো।’ এখন কাঁচামাল ও পণ্যের প্রবাহে পরিবর্তন এনে পুরো ভ্যালু চেইনকে পুনর্গঠিত করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিকভাবে একে অপরকে দোষারোপ করছি, অথচ পাশেই চীন বিকশিত হচ্ছে। চীনকে বাদ দিয়ে বাণিজ্য ভাবনা একটা ফ্যান্টাসি। এই মুহূর্তে এশিয়ার প্রত্যেকটি দেশের বৃহত্তম সহযোগী হচ্ছে চীন। চীনের নেতৃত্বেই এশিয়া এখন বিশ্ববাণিজ্যের বড় অংশ পরিচালনা করছে। আর এই প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থায় ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন সংরক্ষণবাদ বেছে নিয়েছে। মিস্টার ট্রাম এখন সংরক্ষণবাদের নেতা সেজেছেন। এর ফল হলো এশিয়া এখন বৈশ্বিক রিজার্ভের ৭০ শতাংশ সরবরাহ করছে।’
এসব বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে কাঠামোবদ্ধ সংস্কারের দিকে অগ্রসর হতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক বাণিজ্যের অন্যতম স্কলার ড. সামান কেলেগমার (মৃত্যু ২০১৭) স্মরণে আয়োজিত দক্ষিণ এশীয় প্যানেল আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বিমসটেকের সেক্রেটারি জেনারেল মো. শহীদুল ইসলাম, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কোনাল সেন, শ্রীলঙ্কার আইপিএস’র নির্বাহী পরিচালক দুসনি ওয়েরেকুন, নেপালের এসডিপিআই’র চেয়ারম্যান ড. পশ রাজ পান্ডে, ভারতের আরআইএস’র অধ্যাপক ড. প্রবীর দে প্রমুখ। এতে পাকিস্তানের এসডিপিআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আবিদ কাইয়ুম সুলেরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নেন।
আলোচনায় বক্তারা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বৃদ্ধির এবং বিশ্ববাণিজ্যে বড় অংশীদারিত্ব অর্জনের জন্য বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাগুলোকে সক্রিয় করার আহ্বান জানান।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কিছু প্রতিষ্ঠান নীতি প্রণয়ন করে, কিছু আছে নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ করে, আর কিছু প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন করে। এছাড়া সার্ক, বিমসটেকের মধ্যে আঞ্চলিক সংস্থা আছে, দ্বিপাক্ষিক এফটিএ আছে, শুধু খাতভিত্তিক উদ্যোগও থাকতে পারে। এই সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে সক্রিয় করতে হবে।’
রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ব্র্যাক সেন্টারে দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশ বিদেশের অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা অংশ নেন।
‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এ সম্মেলনে মূলত অন্তর্ভুক্তিমূলক বাণিজ্য ও উন্নয়নকে প্রাধ্যান্য দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে দেশ ও আঞ্চলিক পর্যায়ে পিছিয়ে পড় দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র শিল্পের নিরাপত্তার কথা আলোচনা হয়। একই সঙ্গে উন্নত দেশের পাশাপাশি স্বল্পন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের বিষয়কেও গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন আলোচকরা।
এতে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ২৭টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। সম্মেলনের উদ্বোধনী সেশনে সানেমের চেয়ারম্যান ড. বজলুল হক খন্দকারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী সেশনে বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বক্তব্য দেন।
(ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন