ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এখন ভারত সফরে। দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ বৈঠক হয়েছে। সই হয়েছে ৯টি সমঝোতা চুক্তি। বলা হচ্ছে, দুদেশের সম্পর্ক শুধু জেরুজালেম প্রশ্নে আটকে থাকতে পারে না।
ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ২৫ বছরের মধ্যে উভয় দেশ একে অপরের এত কাছাকাছি এর আগে আর কখনো হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রচলিত কূটনৈতিক প্রোটোকলের সব বিধি ভেঙে নতুনদিল্লি বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে গিয়ে যেভাবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, সেটা যেন বন্ধুত্বের এক প্রতীক হয়ে দাঁড়ালো। অনুরূপটা হয়েছিল গত বছর প্রধানমন্ত্রী মোদী যখন ইসরাইল সফরে গিয়েছিলেন। সেখানেও মোদী-নেতানিয়াহুর আলিঙ্গন। একে অপরকে নাম ধরে ডাকা।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী সস্ত্রীক নেতানিয়াহুকে নিজের বাসভবনে নৈশভোজে আমন্ত্রণ করা। এই আন্তরিকতা, এই শরীরী ভাষা শুধু দু'দেশের নয়, দুই নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্কেও যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা। এই আন্তরিকতা ভবিষ্যত ঘনিষ্ট সম্পর্কের ইঙ্গিতবাহী।
গত সোমবার দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ বৈঠকের পর সই হয় ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষি, প্রতিরক্ষা উৎপাদন, সাইবার নিরাপত্তা, অপ্রচলিত বিদ্যুৎশক্তি, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সহযোগিতা, হোমিওপ্যাথি ওষুধপত্র, মহাকাশ বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমঝোতাপত্র। ভারতের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা আবার শুরু করার কথা বলা হয়।
ভারতের তরফে বলা হয়, এ বিষয়ে ইসরাইলের সব অসুবিধার সমাধানে ভারত রাজি, যাতে ভারতে ইসরাইলের ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ মসৃণ হয়। বৈঠক শেষে উভয় প্রধানমন্ত্রী এক যৌথ বিবৃতিতে দেন। তাতে সন্ত্রাস দমনে যে-কোনো পদক্ষেপ নেবার ওপর জোর দেওয়া হয়। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তিনি একজন বিপ্লবী নেতা, যিনি ভারতে বিকাশের এক বিপ্লব ঘটিয়েছেন।
জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করার প্রশ্নে জাতিসংঘে ইসরাইলের বিপক্ষে ভারতের ভোট দেবার প্রসঙ্গে নেতানিয়াহু বলেন, জেরুজালেম নিয়ে একটা ভোটে দু'দেশের সম্পর্ক বদলে যাবে না। এর বাইরে অনেক সহযোগিতার সুযোগ আছে।
উল্লেখ্য, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সংক্রান্ত চিরাচরিত নীতি-অবস্থানে ভারত অবিচল থাকে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে বলা হয়, ভারত ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা অবিলম্বে আবার শুরু করা দরকার। দরকার আলোচনার মাধ্যমে উভয়পক্ষের গ্রহণযোগ্য একটা সমাধান। প্রতিনিধি পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ বৈঠকে জেরুজালেম ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তেল আবিব জানে, মোদী খুব শিগগিরই পশ্চিম এশিয়া সফরে যাচ্ছেন এবং ফিলিস্তিনের রামাল্লাতেও যাবেন। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটা ভারসাম্য নীতি বজায় রেখে চলেছে দিল্লি।
মঙ্গলবার সকালে নতুনদিল্লি এসে পৌঁছেন ২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বরের মুম্বাই সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষদর্শী মোশে হলসবার্গ। সেই অভিশপ্ত দিনে হলসবার্গের বয়স ছিল মাত্র দু'বছর। ছিল মা-বাবার কোলে। মুম্বাইয়ের নরিম্যান হাউসে। সন্ত্রাসী হামলায় মা-বাবা মারা যায়। নানী নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাচ্চাটিকে কোনোমতে বাঁচায়। আজ সে ১১ বছরের কিশোর।
প্রধানমন্ত্রী মোদী তার ইসরাইল সফরে হলসবার্গকে ভারতে আসতে বলেছিলেন। মুম্বাইয়ের নরিম্যান হাউসে আগামী বৃহস্পতিবার ঐ কিশোর ২৬-১১-র সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের একটি স্মৃতি ফলকের আবরণ উন্মোচন করবে। ২৬-১১-র কথা উঠতেই কিশোরের মনে পড়ে, ঐ বিল্ডিংয়েই তার মা-বাবা তাকে শেষ চুম্বনটি দিয়েছিল।
নতুনদিল্লিতে পৌঁছে নেতানিয়াহু তিন মূর্তি মার্গের স্মারক বেদীতে সস্ত্রীক শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এই রাস্তার নতুন নামকরণ হয় ‘তিন মূর্তি হাইফা মার্গ'। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইসরাইলের হাইফা শহরটিকে মুক্ত করতে লড়াই করেছিল ভারতীয় সেনারা। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এসেছেন শ' খানেক ইসরাইলি কোম্পানির ১৩০ সদস্যের এক বাণিজ্য প্রতিনিধিদল। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আগ্রার তাজমহল দেখে যাবেন মুম্বাই এবং মোদীর রাজ্য গুজরাটে।
ভারত ও ইসরাইলের এই গলাগলির কি বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে? উত্তরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানি প্রতীপ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ট সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে ভারতের সৌহার্দের প্রতিফলন। দ্বিতীয়ত, ভারত একটা শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে ওঠার দিকে ক্রমশ এগোচ্ছে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ভারত এককালে যেসব সামরিক সহায়তা পেতো, এখন সেটা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের মতো দেশ থেকে পেতে চাইছে দিল্লি। ফলে এটাকে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির দিক থেকে এক বড় পদক্ষেপ বলে মনে করা যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, তবে এরদিকে হয়ত ভারতের নেহেরুপন্থি এবং বামপন্থি দলগুলি ভারত তার পররাষ্ট্র নীতির স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলছে এবং সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে বলে আঙ্গুল তুলতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাত্ত্বিক দিক থেকে দেখতে গেলে ভারত-ইসরাইল বন্ধুত্ব বাস্তববাদী চিন্তার ফসল এবং সেটা হবারই কথা।
ইসরাইলের ফিলিস্তিন নীতির বিরুদ্ধে ভারতের বামপন্থি দলগুলি ইন্ডিয়া গেটের কাছে প্রতিবাদ জানায়। সিপিআই নেতা ডি. রাজা বলেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড জবরদখল করে রাখার ইসরাইলি নীতির বিরোধী। তারা জাতিসংঘের প্রস্তাবিত দুই রাষ্ট্র গঠনের সমর্থক।
সূত্র: ডয়চে ভেলে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন