মঈনুল আলম
রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্নকরণ অভিযানের মূল পরিচালক মিয়ানমারের সেনা সর্বাধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লেইং বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড়ে দুর্বল হননি। বরং মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্বাক্ষর এবং পোপের মিয়ানমার সফরের মধ্য দিয়ে তিনি কূটকৌশলে নিজেকে আরো শক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছেন বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।
মহামান্য পোপ মিয়ানমার সফরকালে এই জেনারেলের দাবি মেনে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকেন! পোপ এই জেনারেল হ্লেইংয়ের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় পেয়েছিলেন! এরপর পোপ অং সান সু চির সাথে বৈঠক করেন। দুই বৈঠকেই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি কোনো পক্ষ থেকেই উচ্চারিত হয়নি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার সার-বিবরণ মিডিয়াতে প্রকাশ পায়নি। যতদূর জানা যায়, এই দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি লিখিত হয়নি মিয়ানমারের চাপে। এটা ওই জেনারেলের একটি কূটনৈতিক বিজয় বলে প্রতিভাত হচ্ছে। বিশ্ব অং সান সু চিকে মিয়ানমার সরকারের শীর্ষ ক্ষমতার অধিকারী মনে করলেও বাস্তবে তিনি প্রকৃত ক্ষমতাধর মিলিটারি ‘জান্তা’র নৃশংসতম চেহারাকে বিশ্বের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখার একটি ঢাল মাত্র! জেনারেল মিন অং হ্লেইং অত্যন্ত সফলভাবে সু চিকে এড়িয়ে গিয়ে মিয়ানমার সরকারে নিজেকে ক্ষমতার মূল অধিকারী করে নিয়েছেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে অং সান সু চি বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করলে অং-এর পরবর্তী পদক্ষেপে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় জেনারেল মিন-এর। তিনি মিয়ানমারের সংবিধানে পরিবর্তন এনে অং সান সু চি’র প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে সু চিকে ‘স্টেট কাউন্সেলর’ পদে আসীন করে সরকার পরিচালনা করছেন বলে দেখানো হয়। অং সান সু চি এবং জেনারেল মিন অং কদাচিৎ পরস্পরের সাথে কথা বলেন, পরস্পরে সাক্ষাৎ করা তো দূরের কথা।
জেনারেল মিন অং নিজের হাতে ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল হচ্ছে- মন্ত্রিসভার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রীদের তিনিই নিযুক্তি দেন; পুলিশ এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর তিনি সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব রাখেন। সংসদের এক-চতুর্থাংশ সদস্য তার মনোনয়নেই নির্বাচিত হন। এই সদস্যরা তার হাতে থাকায় তার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে সংসদে সংশোধনী গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। জেনারেল মিন অং মিয়ানমারের বৃহত্তম দুটি ব্যবসা ‘কঙলোমারেট’-এর প্রধান। জেনারেল মিন অং কদাচিৎ জনসমক্ষে আসেন এবং তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন না। তার বক্তব্য তিনি ফেস বুকে দিয়ে দেন, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার বক্তব্য ‘টুইটার’ এ দিয়ে থাকেন। যারা জেনারেল মিন অং-এর সাথে কথা বলেছেন, তাদের ধারণা এই জেনারেল অতি গভীর চিন্তার কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ‘স্ট্র্যাটেজিস্ট’। তিনি মিয়ানমারের বর্মী অধিবাসীদের মনে প্রচণ্ড জাতীয়তাবাদী আবেগ এবং অবর্মীদের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষ সৃষ্টি করে এগিয়ে যাচ্ছেন। অং সান সু চির অন্যতম উপদেষ্টা উ উইন থেইন বলেছেন, ‘তার পরিকল্পনা হচ্ছে ২০২০ সালে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হওয়া।’
এই জেনারেল ২০০৯ সালে পূর্ব মিয়ানমারের দুটি জাতিতাত্ত্বিক অঞ্চল থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দুটি জাতিগোষ্ঠীকে নিষ্ঠুরভাবে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। প্রথমে, থাইল্যান্ড সীমান্তের সন্নিহিত এলাকা থেকে ‘শান’ জাতিগোষ্ঠীকে বের করে দেয়া হয়। তারপরে চীন সীমান্তের সন্নিহিত এলাকা থেকে ‘কোকাং’ জাতিগোষ্ঠীকে বের করে দেয়া হলো। এ সময় অভিযোগ ওঠে বর্মী সৈন্যরা ব্যাপকভাবে খুন, ধর্ষণ এবং ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। এর দু’বছর পরেই জেনারেল মিন অং সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সর্বাধিনায়ক পদে পদোন্নতি পান। ২০০৯ সালে যে নিষ্ঠুরতম প্রক্রিয়ায় এই জেনারেল ‘শান’ ও ‘কোকাং’দের মিয়ানমার থেকে বের করে দিয়েছিলেন, বরং আরো নিষ্ঠুরতম প্রক্রিয়ায় তিনি গত তিন মাসে রাখাইনের সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছেন!
জেনারেল মিন অং নিজ হাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ‘জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট’ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে সমগ্র মিয়ানমার সরকারের দৈনন্দিন প্রশাসন পরিচালনা ও নীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এখানে ‘স্টেট কাউন্সেলর’ অং সান সু চি’র হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতাই নেই। ‘টুইটার’ ও ফেসবুকে জেনারেল মিন অং অভিযোগ করছেন বিদেশী সংস্থাগুলো তাদের ধমক দিচ্ছে; তিনি বিদেশী সংবাদ সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সম্পর্কে ‘প্রকৃত সত্য গোপন করার’ অভিযোগ আনছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ হতে আগত ও বহিরাগত। অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্কট মারসিয়েলের সাথে বৈঠকের পর তিনি ফেসবুকে লিখেন, ‘বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনকারী বাঙালিদের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হচ্ছে তা অতিরঞ্জিত।’
এমন একজন জেনারেল ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানকালে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো কতটুকু সম্ভব হবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, প্রবাসী
নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন