স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। প্রায় নয় মাসের এ যুদ্ধ চলাকালে কাগুজে মুদ্রা বা অর্থকেও মুক্তির বার্তা বহনের সার্থক মাধ্যম করেছিল বাঙালি। হানাদার হটানোর মরিয়া যুদ্ধে নিরত বাংলাদেশে কাগুজে নোট ছাপানোর উপায় ছিল না। এজন্য কুশলী বাঙালি বেছে নিয়েছিল পাকিস্তানের ব্যাংক নোটকেই। বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের ঘোষণার বাহনও হয়েছিল এসব নোট।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত অথবা মুদ্রিত কাগুজে মুদ্রার অনন্য দলিল স্ট্যান্ডার্ড ক্যাটালগ অব ওয়ার্ল্ড পেপার মানি। ক্যাটালগটিতে ‘বাংলাদেশ’ নামে যে এন্ট্রিগুলোর টিকা ও ছবি দেখা যায়, তার প্রথমেই রয়েছে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ইস্যুকৃত চারটি নোট। প্রতিটি নোটের সামনের পিঠে গোলাপি রঙের বিশেষ ছাপে বাংলা ও ইংরেজিতে ‘বাংলা দেশ’ লেখা। এগুলো ওভারপ্রিন্ট বা উপরিমুদ্রণ, যা নোটের মূল ছাপার ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ক্যাটালগে এ চারটি নোট ‘১৯৭১ প্রভিশনাল ইস্যু’ নামে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। তার নিচে সংক্ষিপ্ত টিকায় লেখা, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু কখনো ওভারপ্রিন্টেড নোট ইস্যু করেনি, তাই এগুলো হয়তো স্থানীয় বা আঞ্চলিক কোনো কর্তৃপক্ষ ইস্যু করেছে।’
আসল ঘটনা তা নয়। এসব নোট আসলে গ্র্যাফিতির কাজ। নোটগুলো কখনো বাংলাদেশে ছাড়া হয়নি। বাংলাদেশের নামাঙ্কিত এসব নোট ছাড়া হয়েছিল সেদিনের পশ্চিম পাকিস্তানে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে এসব নোট উদ্ধার, জব্দ ও ধ্বংস করা হয়। তার পরও পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ১৯৭১ সালের ১০ জুন ডনে প্রকাশিত নিবন্ধে করাচির বিভিন্ন জলপথে ‘বাংলা দেশ’ ও ‘জয় বাংলা’ ওভারপ্রিন্টেড ১০০ রুপি ও ৫০০ রুপি নোটের দেখা পাওয়ার কথা জানা যায়। ওই নিবন্ধের সঙ্গে ‘বাংলা দেশ’ ওভারপ্রিন্টেড ১০০ রুপির একটি নোটের ছবিও ছেপেছিল ডন। ওভারপ্রিন্টেড নোটের উৎপত্তি হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন স্থানে ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটে। লুট করা ওই নোটের ওপরই ‘বাংলা দেশ’ ও ‘জয় বাংলা’ শব্দবন্ধ ওভারপ্রিন্ট করা হয়।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এই ওভারপ্রিন্ট নোটের কারণে কী পরিমাণ বেসামাল বোধ করেছিল, সেটা বোঝা যায় ১৯৭১ সালের ৮ জুন ইয়াহিয়া খানের জারিকৃত সামরিক আইনে। ‘মার্শাল ল রেগুলেশন নাম্বার এইটি ওয়ান’-এ বলা হয়,
“নিম্নে বর্ণিত পাকিস্তানি নোটগুলো উদ্ধৃত তারিখ থেকে ১৯৫৬ সালের স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান অ্যাক্টের ২৫ ধারায় বর্ণিত কার্যকারিতা হারাবে—
(ক) পাকিস্তানের যেসব ব্যাংক নোটে ‘জয় বাংলা’ অথবা ‘বাংলা দেশ’ অথবা একই রকম অন্য কোনো শব্দ লিখিত, চিহ্নিত, সুচকর্মে মুদ্রিত রয়েছে, অথবা কোনো ভাষায় ‘ঢাকা’ (Dacca) শব্দটি ছাপা অথবা খোদাই করা হয়েছে;
(খ) ৫০০ রুপি ও ১০০ রুপি মুদ্রামানের পাকিস্তানি ব্যাংক নোট। এই আইন কার্যকর হবে ৮ জুন ১৯৭১ তারিখ থেকে।”
উপরের আইনের (ক) অংশটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পাকিস্তান সরকার ৫০০ ও ১০০ রুপি নোট ঢালাওভাবে বাতিল করে। পাশাপাশি তারা ‘জয় বাংলা’ ‘বাংলা দেশ’ ‘ঢাকা’ অথবা সমার্থক অন্য কোনো শব্দ লেখা অন্যান্য মানের নোটও বাতিল করে। অর্থাৎ পাকিস্তানের সব মানের নোটে বাংলাদেশের নামের ওভারপ্রিন্ট পশ্চিম পাকিস্তানে এত ছড়িয়ে পড়েছিল যে, জবরদস্ত সামরিক সরকার ওইসব মুদ্রা বহন অথবা লেনদেন নিষিদ্ধ নয়, রীতিমতো বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের ওই সিদ্ধান্তের কারণে এসব নোট মানুষের হাতে হাতে ছড়ায়নি অথবা লেনদেন হয়নি। নইলে নিশ্চিতভাবেই সংগ্রাহকদের আগ্রহের বিষয় হতো ‘রাজনৈতিক’ ও ‘ঐতিহাসিক’ গুরুত্বসম্পন্ন এসব নোট।
এর আগে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাপন্থীরা ১৯২২ সালে ‘আইরিশ ফ্রি স্টেট প্রভিনশিয়াল গভর্নমেন্ট’ ওভারপ্রিন্ট করে। তবে তা ব্রিটেনের ডাকটিকিটে। ব্যাংক নোটে ওভারপ্রিন্টের পুরোধা বাঙালিরাই। আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কয়েক দশক পর এ কৌশল প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র, তবে সেটা কোনো স্বাধীনতার লড়াই হিসেবে নয়। আফগানিস্তান দখলের পর আফগান ব্যাংক নোটে মার্কিনিরা বিভিন্ন স্লোগান ওভারপ্রিন্ট করে। যেমন, ‘তোমাদের মুদ্রার সঙ্গে এই কাগজের কোনো পার্থক্য নেই’ অথবা ‘এই কাগজকে পাস হিসেবে ব্যবহার করে বেরিয়ে যাও সেই যুদ্ধ থেকে যেখানে তুমি মরতে চাও না’।
স্ট্যান্ডার্ড ক্যাটালগ ওয়ার্ল্ড পেপার মানিতে পাকিস্তানের ওভারপ্রিন্টেড নোটগুলোর মধ্যে দুটিতে সামনের পিঠে বাংলায় কোনো লেখা নেই। ১ রুপি ও ১০ রুপি নোটে সামনের পৃষ্ঠায় শুধু উর্দু লেখা। তবে ১০ রুপি নোটের পেছনের পিঠে বাংলা অক্ষরে ‘১০’ লেখা। পাকিস্তানের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি বাংলাভাষী হলেও সে দেশের ব্যাংক নোট ও মুদ্রায় দীর্ঘদিন কোনো বাংলা অক্ষর ছিল না। ষাটের দশকে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান বাংলা অক্ষরসংবলিত নতুন কিছু নোট বাজারে ছাড়া শুরু করে। তবে ১৯৭০ সালে অসহযোগ আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখনো বাংলা অক্ষরসংবলিত ১ রুপি ও ১০ রুপি নোট বাজারে আসেনি। বাঙালি তার ভাষার প্রতি পাকিস্তানের এ বিরাগের খেদ মেটানোর সুযোগ পায় মুক্তিযুদ্ধের সময়। নিজের বোধের অগম্য ভাষায় মুদ্রিত নোটগুলোয় বাঙালি তখন নিজের ভাষায় নিজের দেশের নাম ‘বাংলা দেশ’ লিখে দেয়। নিজেদের বার্তা প্রচারে পাকিস্তানের মুদ্রাকে বাহন করার যে কৌশল বাঙালি সেদিন নিয়েছিল, সেটা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক লড়াইয়ে অর্থের অভিনব ব্যবহারের সার্থক দৃষ্টান্ত।
কাগুজে মুদ্রা বিষয়ে খ্যাতিমান গবেষক পিটার জে. সাইমস প্রায় এক দশক দায়িত্ব পালন করেছেন ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক নোট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে অন্যান্য সূত্রের পাশাপাশি তার নিবন্ধের তথ্যও ব্যবহার করা হয়েছে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন