জার্মান দেশীয় গোয়েন্দাদেরকে বাহবা দিতেই হয়, ২০১৫ এর ডিসেম্বর মাসে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা বিএনডি বিভিন্ন বার্তাসংস্থাকে দেড় পৃষ্ঠাব্যাপী একটি স্মারকলিপি কিংবা আরো খোলাসা করে বললে, একটা সতর্কবার্তা প্রদান করে যার শিরোনামটা ছিল, আঞ্চলিক ও সুন্নি শক্তি সৌদি আরব পরররাষ্ট্র নীতির মৌলিক পরিবর্তন এবং জাতীয় শক্তি সংহতিকরণের দোলাচলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন (হওয়ার পথে)। সেই সময় যখন সৌদি আরব ঠিক এখনকার মত উত্তপ্ত কড়াইয়ে পরিণত হয় নি, তখন এরকম একটি গোয়েন্দা রিপোর্টে আপাতদৃষ্টে অদ্ভুতুড়ে ভবিষ্যদ্বাণী এবং অকূটনৈতিক স্পষ্ট ভাষা সম্বলিত হওয়ায় সারা দুনিয়ার জন্যেই ছিল আশ্চর্যজনক।
রিপোর্টটি এমনো সতর্কবাণী উচ্চারণ করে যে, সৌদি বংশের প্রবীণ সদস্যদের কূটনৈতিক সতর্কাবস্থা অতি দ্রুতই পরিবর্তিত হবে। এবং সেই স্থান দখল করবে আবেগী-অসহিষ্ণু আগ্রাসননীতি। সেসময় সদ্য ক্রাউন প্রিন্সের তকমা অর্জন করা ৩০ বছর বয়সী রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে ইংগিত করে এই মন্তব্যটি করা হয়।
বিএনডি গোয়েন্দা সংস্থা আরো বলে, বাদশা সালমান এবং তার এই পুত্রটির মনস্কামনা এই যে, সৌদি আরব অচিরেই যেন আরব বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত হয় এবং এর বৈদেশিক নীতি হবে শক্তিশালী সামরিক বা যুদ্ধংদেহী নীতির উপর ভিত্তি করে। এই গোয়েন্দা সংস্থা এও সতর্ক করে দিচ্ছে যে, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং পিতার পর নিজের সিংহাসনে আরোহণের পথ মসৃণ করার জন্যে এই তরুণ তুর্কির সীমা লঙ্ঘন করার ঝুঁকি লুক্কায়িত রয়েছে। তারা আরো বলে যে, (আঞ্চলিক প্রভাব দৃঢ়তর করতে) আঞ্চলিক মিত্র এবং মিত্র পরাশক্তিদের সাথে সম্পর্ক বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
অবশেষে সেই ভয়ই সত্য হলো। রিয়াদের সাথে কূটনৈতিক এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে চিন্তিত জার্মান সরকারি মহলে নিন্দিত এই রিপোর্টটিই অবশেষে ঐশ্বরিক ভবিষ্যদ্বাণীর মতো ফলে গেল।
উপসাগরীয় অঞ্চলটির বর্তমান অবস্থাই না হয় বিবেচনা করুন। রাজবংশের অপর ১১ জন রাজপুত্রকে-যাদের মধ্যে রয়েছে হাল দুনিয়ার অন্যতম সর্বোচ্চ ধনী, জাতীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর প্রধান-দুর্নীতির দায়ে পদচ্যুত কিংবা গ্রেফতার করে, রিটজ কার্ল্টন হোটেলে বন্দি রাখাটার চেয়ে বেশি আগ্রাসী আর কিই বা হতে পারে? তাও আবার তার পিতা কর্তৃক গঠিত একটা দুর্নীতিবিরোধী কমিটির দায়িত্ব গ্রহণের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই, যখন দুর্নীতির প্রেক্ষিতে তার নিজের ভাবমূর্তিই একেবারে সুবিধার নয়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, গত বছর তিনি উত্তর ফ্রান্সে যে বিলাশবহুল অবকাশ যাপন করেছেন তার কথা। সেখানে খুবই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছিল যে, এই প্রিন্স কি অবকাশ যাপনের জন্যে পাঁচশত মিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি লাভ করে থাকেন (যথাযথ উপায়ে)?!
আপনি যখন আপনার দেশে সফররত অপর কোন দেশের এক প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবেন, এবং আপনার দেশে একরকম গৃহবন্দি করে রাখবেন তখন কি এটাকে আগ্রাসী এবং অবৈধ হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছু বলা যাবে (যদিও দুর্ভাগা লেবাননের পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি মিডিয়ায় বলেছেন যে, তিনি দ্রুতই দেশে ফিরবেন, কিন্তু তারপরেও লেবাননে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রীর মিত্র এবং সভাসদগণ হারিরির ব্যবহারকে অস্বাভাবিক বলে জানিয়েছেন এবং তার জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন)? কিংবা ইয়েমেনের প্রেসিডেন্টের কথাই চিন্তা করা যাক। একটি অনুসন্ধানী তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, সৌদি সরকার ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট, তার পুত্রদের, মন্ত্রী এবং সামরিক ব্যাক্তিদেরকে সৌদি ত্যাগ করার উপর মাসের পর মাস নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দুই দুইটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ন্ত্রিত পন্থায় রেখে দেয়া এবং যাকে পদচ্যুত করে সৌদি রাজতন্ত্রের ক্রাউন প্রিন্স তথা হবু-বাদশা হয়েছেন তাকে প্রাসাদ-বন্দি করে রাখা আর যাই হোক কেবল আগ্রাসী-অসহিষ্ণু আচরণেরই প্রমাণ দেয় না, বরং প্রমাণ দেয় তার উপরে পাশ্চাত্যের শাসকশ্রেণির কৃপাদৃষ্টিরও। একবার কল্পনা করুন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব কেমন হতো যদি আজকে ইরান ইরাকের প্রধানমন্ত্রীকে নিজ দেশে ডেকে এনে তাকে ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলের সামনে পদত্যাগ করতে বাধ্য করত এবং গৃহবন্দি করে রাখত? কিন্তু এতো আর ইরান নয়, সৌদি আরব! তাই, এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার টুইট বার্তায় সৌদি ক্রাউন প্রিন্স এবং তার পিতা বাদশার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। অন্যদিকে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সশরীরে রিয়াদে এক ঝটিকা সফরে এসে তাঁর দেশের জন্যে (ফ্রান্সের ব্যবসায়িক স্বার্থে) সৌদিকে উন্মুক্ত করে দেয়া এবং সৌদিতে মডারেট ইসলামের সূচনা করায় প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে স্যালুট করে যান!
আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহায়তায় সমগ্র উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যেরূপ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে তাতে সৌদি আরবের এই ক্রাউন প্রিন্সের ভূমিকাকে কি উক্ত গোয়েন্দা ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লিখিত মিত্র প্রতিবেশীদের উপর মোড়লসুলভ বাড়াবাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি না? আসলে ক্রাউন প্রিন্স আর তার সহযোগীরা হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন সামরিক শক্তিহীন পুঁচকে কাতারকে শায়েস্তা করতে একদিনে না হলেও এক সপ্তাহই যথেষ্ট। কিন্তু পাঁচ মাসের বেশি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখনো কাতার সৌদি আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের বালসুলভ অন্যায়-আবদারগুলোর ব্যাপারে থোরাই কেয়ার করছে। মচকাবার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না; বরং আল জাজিরার মতো কাতারি নিয়ন্ত্রণাধীন নিউজ চ্যানেলের নেটওয়ার্ক সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার পরে হিতে বিপরীত হয়েছে। কাতার, সৌদির জাতশত্রু তুর্কি আর ইরানিদের সাথে গাটছাড়া বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে। স্বাগতম জনাব ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান!
এরপর ইয়েমেনের কথাতেই আশা যাক। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধনবান রাষ্ট্র সৌদি আরব সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র ইয়েমেনে আগ্রাসন চালানোর পর দুদুটি বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এই যুদ্ধ শেষ করে (সম্মানের সাথে) সরে আসার পথ পাচ্ছে না সৌদি আরব। আর এই যুদ্ধটির জন্যে এককভাবে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকেই দায়ী করা যায়। কারণ, তিনি প্রায় একক ক্ষমতায় এই যুদ্ধটি শুরু করছেন, যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছেন, এর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন আর এই যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক অবস্থাকে ত্বরান্বিত করেছেন। কিন্তু সৌদির রক্ষণদুর্গের ভেতরে হুথি সংগ্রামীরা যখন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় এবং যেটা এই প্রিন্সের ভাষায় সৌদির বিরুদ্ধে ইরানের সরাসরি সামরিক আগ্রাসন, তখন কি এটাকে সৌদি এবং ক্রাউন প্রিন্সের পরাজয় হিসেবে ধরে নেয়া যাবে না? এদ্দিনে তো সৌদির পরাক্রমশালী বিমানবাহিনীর আগ্রাসনে পুঁচকে হুথি বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু হুথিদের দুর্বল করতে না পারলেও ইয়েমেনে এলোপাতারি বোমা-বিমান হামলা করে নারী-শিশু-বৃদ্ধ আর বেসামরিক মানুষের উপর সরাসরি হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এবং মানবিক ও ত্রাণ সহায়তা থেকে অবরুদ্ধ করে রেখে, কলেরার প্রকোপ ঘটিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে মানবিক দুর্দশা ও সংকটগ্রস্ত রাষ্ট্রে পরিণত করছে ইয়েমেনকে! আর লজ্জাজনকভাবে আবারো এই সপ্তাহে ক্রাউন প্রিন্স এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে ইয়েমেনে মানবিক ত্রাণসামগ্রী প্রবেশের প্রতিটা পথ বন্ধ রাখায় কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে।
লেবানন থেকে কাতার, কাতার থেকে ইয়েমেন প্রতিটা দেশে এই গুনধর রাজপুত্র মিডাস রাজার উল্টোরূপে প্রতীয়মান হয়েছে। মিডাস রাজা কোথাও হাত ছোঁয়ালে তা সোনায় পরিণত হতো। আর ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যেখানেই হাত ছোঁয়াচ্ছেন তাই ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। সম্ভবত জার্মান গোয়েন্দারা বাদশা সালমানের আস্কারা পাওয়া এই ননীর পুতুলের ধ্বংসাত্মকতাকে অবমূল্যায়ন করে ফেলেছিল! বরং এই ক্রাউন প্রিন্সের ব্যাপারে সবচেয়ে অস্বস্তিকর সত্য এটাই যে, উনি কেবল আগ্রাসীই নন; বরং অযোগ্য। শুধু উচাভিলাসীই নন; বরং উন্মত্ত। তিনি একজন জাতীয়তাবাদী এবং বাজপাখির মতো যিনি নিশানা করছেন ইরান-সৌদি ঠাণ্ডা যুদ্ধকে একটা প্রকাশ্য ,সহিংস এবং উত্তপ্ত যুদ্ধে রূপ দান করার দিকে, এমনকি সে জন্যে তিনি অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথেও গাঁটছড়া বাঁধতে ছাড়ছেন না। এমতাবস্থায়, ইনিই যদি হন আরবদের নতুন নেতা, তবে আল্লাহ! তুমি আরবদের সহায় হও! ইন্টারসেপ্ট থেকে অনুবাদ করেছেন মাহদি মাহমুদ
[মেহদি হাসান: প্রথিতযশা ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক। আল জাজিরা টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রযোজক। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল সেন্টারের মুসলিম-খ্রিস্টান আন্ডার্স্ট্যান্ডিং বিষয়ের শিক্ষক]
আস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন