ষাটোর্ধ্ব দুই নারী। মাথায় সাদা চুল। পাশের কিশোরীর সঙ্গে নাচতে নাচতে আলগা হয়ে গেছে তাঁদের মাথার স্কার্ফ। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তাঁদের। যেন মুক্তির আনন্দে নাচছেন তাঁরা! ঘটনাস্থল তুরস্ক, আর এই দুই নারী ইরানি পর্যটক।
শুধু এই দুই নারী নন, তাঁদের সঙ্গে আরও অনেক ইরানি পর্যটক তুরস্কের ভেন শহরের নাইট ক্লাবে এমন আনন্দে মাতেন। কেউ একা, কেউবা সপরিবারে নাচে-গানে অংশ নেন। আবার কেউ কেউ খাবার টেবিলে নানা পদের খাবার আর বিয়ার নিয়ে শুধুই দর্শকের ভূমিকায়। ডিজে থেকে শুরু করে পানশালার ছেলেটিও ইরানি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, তুরস্কের বুকে এক টুকরো ইরান!
তুরস্কের পূর্বাঞ্চলীয় শহর ভেন। তুরস্ক-ইরান সীমান্তের বেশ কাছেই এর অবস্থান। কুর্দি অধ্যুষিত ভেনের রয়েছে সুদীর্ঘ নগর ঐতিহ্যের ইতিহাস। সঙ্গে মনকাড়া লেক আর প্রাকৃতিক দৃশ্য। ভেনের সৌন্দর্য নিয়ে খুব প্রচলিত প্রবাদ হলো-‘পৃথিবীর জন্য ভেন আর পরের জীবনের জন্য স্বর্গ।’ পৃথিবীর বুকের এই স্বর্গ দেখতে ভিড় করেন প্রতিবেশী ইরানিরা। সঙ্গে কয়দিনের জন্য বিধি-নিষেধহীন মুক্ত জীবনের স্বাদও নেন তাঁরা।
সন্ত্রাসী হামলা, ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান আর রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সরকারের চলমান ধরপাকড়ে খানিকটা অস্থিরতা চলছে তুরস্কে। পর্যটন খাতে অনেকটাই ধস নেমেছে। ২০১৫ সালে দেশটিতে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ। পরের বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে আড়াই কোটিতে। জঙ্গিবাদ, জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের তৎপরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা-সব মিলিয়ে পশ্চিমা পর্যটকেরা তুরস্কে ভ্রমণ কমিয়ে দিয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে পর্যটক টানতে তুরস্ক আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সফলতা তেমন নেই। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত, বাহরাইন ও সৌদি আরব থেকে দেশটিতে পর্যটক বাড়ছে। এ ছাড়া ইরান থেকে এবার ২০ লাখ পর্যটকের লক্ষ্যমাত্রা ধরে রেখেছে তুরস্ক।
তবে ভিন্ন চিত্র ভেনে। ইরান থেকে সড়ক পথে ঘণ্টাখানেকের দূরত্ব। তাই ইরানিদের কাছে পছন্দের পর্যটন নগরী এই ভেন। গত বছর এখানে দুই লাখ ৬৪ হাজার ইরানি পর্যটক যান। এ বছর প্রথম নয় মাসেই এখানে গেছেন তিন লাখ ৮৮ হাজার ইরানি। পর্যটকের চেয়ে হোটেলের সংখ্যা কম হওয়ায় থাকার জায়গা নিয়ে বেশ কাড়াকাড়ি থাকে। আগে থেকে বুকিং না করলে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করা একেবারে অসম্ভব।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানি পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকায় স্থানীয়রা ব্যক্তিগতভাবে কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। আর নেবেই না বা কেন! এসব পর্যটকেরা লাখ লাখ ডলার ব্যয় করছে, যাতে লাভবান হচ্ছে এখানকার অর্থনীতি। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ভালো সেবা দিতে এই শহরে সম্প্রতি ফারসি ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর শিক্ষার্থী হিসেবে আসছে স্থানীয় নানা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। এসব উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের এক কর্মকর্তা মজা করে বলেন, ‘নিজের শহরে তো মাঝে মাঝে নিজেকে বিদেশি মনে হয়।’
ইরানিরা কেন ভেন ভ্রমণে যান? শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য দেখতে? নাকি অন্য কোনো কারণও আছে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেকেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর আর্মেনীয় গির্জাসহ হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য দেখতে এখানে যান। ইরানের চেয়ে কম দামে কাপড়-চোপড় পেয়ে অনেকে কেনাকাটা করে সুটকেস ভর্তি করেন।
তবে বেশির ভাগ যান স্বাধীনতা উপভোগ করতে। বিশেষ করে নারীরা। কারণ, সাত বছর বয়স থেকে কড়া পর্দা প্রথা মানতে হয় নারীদের। পর্দার আড়াল থেকে বের হতে, খোলা হাওয়ায় চুল দোলাতে, নিজের মতো পোশাক পরতে, মধ্যরাতের পার্টিতে যেতে, ব্যাপক সাজগোজ করে এদিক-সেদিক স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে ভেন তাদের পছন্দের গন্তব্য। ইরানের নারীরা নিজের দেশে এভাবে চলার সুযোগ পায় না রাষ্ট্রীয় বিধি-নিষেধের কারণে। আর পুরুষেরা এখানে যান নাচ-গান আর পানাহার করতে। নিষেধাজ্ঞার কারণে এমনটা তারা ইরানে ভাবতেই পারে না।
ইরানিদের তুরস্ককে বেছে নেওয়ার বড় কারণ দেশটির উদারপন্থী অবস্থান। তুরস্ক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, তবে সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। ফলে এখানে ইরানের মতো বিধি-নিষেধ মানার বাধ্যবাধকতা নেই। আর এই পরিবেশই ইরানি পর্যটকদের এখানে টেনে নেয়। ইরান থেকে ভেনে বেড়াতে আসা বাহার নামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘আমি আর আমার কিশোরী মেয়ে হিজাব ছাড়া রাতে বাইরে বের হব-ব্যাপারটা ভাবতেই যেন কেমন লাগছিল। শেষমেশ বের হলাম। দেখলাম, কোনো সমস্যাই না এটা। আমরা এখানে খুব ভালো সময় কাটালাম।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন