যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি ঝড় উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শোনা যাচ্ছে যৌন হয়রানির একাধিক অভিযোগ। হার্ভে ওয়েইনস্টেইন থেকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়র—অনেকেই আছেন এ তালিকায়। আর এসব অভিযোগও করছেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নারীরা। দেখা যাচ্ছে, হলিউড থেকে বলিউড, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি—এমন নানা জায়গার নারীরা যৌন হয়রানির কবলে পড়েছেন।
একটি বিষয় সত্যি যে এখন যেসব নারী অভিযোগ তুলছেন, তাঁরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী। কিন্তু সাধারণ নারীদের অবস্থা কী? যুক্তরাষ্ট্রের এমনই কিছু নারীর অভিজ্ঞতা বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে এবং উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করে কাজের কাজ কিছু হয়নি। উল্টো সামাজিক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে নারীদেরই। তবে দু-একটি ক্ষেত্রে নারীরা সুবিচার পেয়েছেন।
যৌন হয়রানির শিকার যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পেশার এমনই কিছু নারীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে। যৌন হয়রানির শিকার নারীদের সম্পূর্ণ নামের শুধু প্রথম অংশ এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।
রিলিন্ডা: মেরিল্যান্ডের একটি কল সেন্টারে কাজ করতেন রিলিন্ডা (৪১)। ফোনে মক্কেলদের ভালোভাবে সামলাতে পারলেও হুট করেই অন্য একটি বিভাগে বদলি করে দেওয়া হয় তাঁকে। সেখানেই যৌন হয়রানির শিকার হন তিন সন্তানের মা রিলিন্ডা। এক সহকর্মী তাঁকে জোর করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এ ঘটনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন রিলিন্ডা। কর্তৃপক্ষের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে বদলি হতে চান তিনি। তা না করে উল্টো রিলিন্ডাকে রিচমন্ড শহরে অন্য চাকরি নিতে বলা হয়। কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যায়বিচার না পেয়ে গত মার্চ মাসে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি।
বোনিতা: টেক্সাসের একটি কারাগারে রক্ষীর দায়িত্বে ছিলেন বোনিতা। তাঁর অভিযোগ ছিল ঊর্ধ্বতন একজন সার্জেন্টের বিরুদ্ধে। বোনিতার চাকরিটি পালাভিত্তিক। দিনে বা রাতে একেক সময় তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে হতো। ওই সার্জেন্ট তাঁর দায়িত্বের জায়গা নির্ধারণ করতেন। প্রহরীর কাজে কারাগারের এক নির্জন স্থানে বোনিতাকে বদলি করা হয়েছিল। সুযোগ বুঝে একদিন তাঁকে ধর্ষণ করেন ওই সার্জেন্ট। এ নিয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলে তদন্ত শুরু হয়। অবাক ব্যাপার হলো তদন্তকারীরা বোনিতাকে তাঁদের লেখা একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে বলে। কিন্তু বোনিতা তাতে স্বাক্ষর করেননি। ধর্ষণের অভিযোগ করার ১৩ মাস পর ওই সার্জেন্টকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এর মধ্যে ওই সার্জেন্টকে পদোন্নতি দিয়ে লেফটেন্যান্টও বানানো হয়! পরে আদালতের মাধ্যমে বোনিতা আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেলেও ওই যৌন নিপীড়কের বিরুদ্ধে অপরাধের কোনো অভিযোগই আনা হয়নি।
অ্যাম্বার: অরিগন রাজ্যের একটি হাসপাতালে সেবিকা হিসেবে কাজ করতেন অ্যাম্বার (২৪)। এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের অভিযোগ এনেছিলেন তিনি। যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর এ নিয়ে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গেও আলোচনা করেছিলেন অ্যাম্বার। তখন জানতে পারেন, আরও অনেক নারীর সঙ্গে একই আচরণ করেছেন ওই ব্যক্তি। এরপরই ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপকের কাছে অভিযোগ করেন অ্যাম্বার। এ নিয়ে অবশ্য ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। অ্যাম্বারকে ওই নিপীড়কের সঙ্গে আর কাজ করতে হয়নি।
ক্যালিসা: একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন ১৯ বছর বয়সী ক্যালিসা। মেরিল্যান্ডের ওই রেস্তোরাঁটি বেশ বিখ্যাত। কাজে যোগদানের পরপরই ক্যালিসাকে ‘আবেদনময়ী পোশাক’ পরার নির্দেশ দেয় ব্যবস্থাপক। ফলে স্কার্ট পরে কাজ করতে বাধ্য হন ক্যালিসা। একদিন ওই ব্যবস্থাপক ক্যালিসাকে নিজের কক্ষে ডেকে নেন এবং তাঁর সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করেন। আরেক দিন রাতের পালা শেষে ওই ব্যবস্থাপক ক্যালিসাকে তাঁর সঙ্গে যেতে জবরদস্তি করেন। কিন্তু সঠিক সময়ে ক্যালিসার বাবা এসে পড়ায় সে যাত্রা বেঁচে যান এই তরুণী। এর পরদিনই সবকিছু জানিয়ে মানবসম্পদ বিভাগে অভিযোগ করেছিলেন ক্যালিসা। মানবসম্পদ বিভাগ থেকে তাঁকে জানানো হয়, এ বিষয়ে আরও কোনো তথ্য জানার প্রয়োজন হলে ক্যালিসাকে ফোন করা হবে। সেই ফোন আর কখনো আসেনি। ওই চাকরি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না ক্যালিসার সামনে। আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে এখন তিনি একজন পুরোদস্তুর আইনজীবী।
শ্যানন: ওয়াশিংটন রাজ্যের একটি ওষুধ কোম্পানিতে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি করতেন শ্যানন (৩২)। কর্মস্থলে তাঁর বেশির ভাগ সহকর্মীই ছিলেন পুরুষ। তাঁরা নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতেন শ্যাননকে। সন্তানের জন্মের পর এটি আরও খারাপ অবস্থায় যায়। উপায়ন্তর না দেখে কর্তৃপক্ষের কাছে সাত পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেন শ্যানন। এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে উল্টো শ্যাননের কমিশন কেটে নেওয়া হয়। তাঁর কাজের মানের উন্নতি করতে বলা হয়! এর প্রতিবাদে শ্যানন আইনের দ্বারস্থ হন। পরে কোম্পানির সঙ্গে ‘পারস্পরিক আর্থিক সমঝোতার’ ভিত্তিতে এর সমাধান হয়। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা আজ অবধি শোনেননি শ্যানন!
জর্ডান: টেক্সাসের একটি হাসপাতালের বিমা বিভাগে সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন ২৭ বছর বয়সী জর্ডান। ওই হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁকে সম্মতি ছাড়াই জড়িয়ে ধরেছিলেন। শুধু জড়িয়ে ধরাই নয়, ওই ব্যক্তি জোর করে চুমু খেয়েছিলেন জর্ডানকে। স্বামীকে জানানোর পর প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগে এ ব্যাপারে অভিযোগ দিয়েছিলেন তিনি। মানবসম্পদ বিভাগ শুরু থেকেই এ বিষয়ে বেশ তৎপর ছিল। সহকর্মী মারফত তিনি জানতে পারেন, ওই নিপীড়নকারীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। জর্ডানের ভাষায়, ‘খবরটি শুনে আমি খুব কেঁদেছিলাম। কারণ, আমার জীবনের এ অধ্যায়টি শেষ হয়েছে। মনে হচ্ছিল, ভয়ে ভয়ে থাকার দিন এখন শেষ। কর্মস্থলে অনিরাপদ থাকার অনুভূতি এখন থেকে শেষ। ওই মুহূর্তের অনুভূতি ছিল এক কথায় অসাধারণ।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন