আপনি যদি সমু্দ্রে সাঁতার কাটা, ডুব সাতার, সার্ফিং বা স্কুবা ডাইভিং করতে উপভোগ করেন তাহলে একটা সময়ে গিয়ে আপনি হয়তো ভাবতে পারেন আপনি সমুদ্রের যে বিশাল জলরাশিতে ভাসছেন তার কতটুকু সামুদ্রিক প্রাণীদের পেট বা দেহ থেকে বের হয়েছে।
সমুদ্রে প্রায় ২২ লাখ প্রজাতির প্রাণী আছে।
২০১১ সালের আগস্টে জার্নাল PLOS Biology-তে প্রকাশিত গবেষণা মতে, সমুদ্রে সর্বশেষ ২২ লাখ প্রজাতির প্রাণীর সন্ধান পাওয়া গেছে।
সমুদ্রে রয়েছে আণুবীক্ষণিক জুপ্ল্যাঙ্কটন থেকে শুরু করে বিশালদেহী সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী যাদের ওজন লাখো পাউন্ড। সমুদ্র শুধু এসব প্রাণির বাসস্থানই নয় বরং টয়লেটও বটে। যেখানে তারা মল-মূত্র ত্যাগও করে। এই মল-মূত্র আবার যেনতেন মল-মূত্র নয় বরং এর আছে নানা পুষ্টিগুন। এই মল-মূত্র আবার সমুদ্রের প্রাণীদেরই সরাসরি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অথবা প্রাকৃতিকভাবে রুপান্তরিত হয়ে সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য নতুন খাদ্য উৎপাদনের কাজেও লাগে। ফলে সার্বিকভাবে সমুদ্রের ইকোলজি বা প্রাণ ও প্রকৃতির বাস্তসংস্থানের ভারসাম্য বজায় থাকে।
এই বিষয়টি বিশেষ করে তিমি মাছেদের বেলায় সত্য।
সমুদ্রের যে রাসায়নিক স্যুপ তাতে তিমি মাছেদেরই সবচেয়ে বেশি অবদান। তবে তিমি মাছেরা ঠিক কতটা পরিমাণে সমুদ্রের পানিতে মল-মূত্র যোগ করে তার সঠিক হিসেব বের করাটা একটু কঠিনই বটে। এমনটাই জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী জো রোমান। যিনি সামুদ্রিক প্রাণ ও প্রকৃতির বাস্তুসংস্থানে স্তন্যপায়ী সামুদ্রিক প্রাণীদের অবদান নিয়ে গবেষণা করছেন।
তবে ডলফিন এবং সিল মাছের মল-মূত্র ত্যাগের পরিমাণ থেকে তিমিদেরও মলমূত্র ত্যাগের পরিমাণ সম্পর্কে একটি ধারণা করা যেতে পারে। কারণ এদেরকে তো বন্দী করে রাখা যায়।
২০০৩ সালে কানাডার জার্নাল অফ জুলজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, বালিন তিমি পরিবারের সদস্য একটি শেই তিমি, যা লম্বায় ৬০ ফুট এবং ওজনে ১ লাখ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে, এমন একটি তিমি দিনে ১৬৬ গ্যালন পেশাব করে। অন্যদিকে, একটি ফিন তিমি যেটি ৮৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং যার ওজন ১ লাখ ৬০ হাজার পাউন্ড (৭২৫৭৫ কেজি) ছাড়িয়ে যেতে পারে এমন একটি তিমি প্রতিদিন ২৫৭ গ্যালন পেশাব করতে পারে।
তিমিরা সাধারণত সমুদ্রের গভীরে গিয়ে খাদ্য সংগ্রহ শেষ করে এসে সমুদ্রের উপরিভাগেই মল-মূত্র ত্যাগ করে। আর তিমিদের মল-মূত্র খেয়েই বেঁচে থাকে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন এবং শেওলা সহ হাজার হাজার প্রজাতি। তিমিদের মল-মূত্র বেশ পুষ্টিকরও বটে। যেসব প্রাণী সমুদ্রের গভীরে গিয়ে পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারেনা তাদেরকে তিমিদের মল-মূত্রই পুষ্টির যোগান দেয়।
তবে এখানেই শেষ নয়। তিমির মল-মূত্র খেয়ে বেঁচে থাকা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনদের খেয়ে বাঁচে আবার আরেকটু বড় জুপ্ল্যাঙ্কটনরা। তাদের খেয়ে বাঁচে মাছেরা। আবার সেই মাছেদের খেয়ে বেঁচে থাকে খোদ তিমিরা। এভাবেই তিমিদের মল-মূত্র সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্যচক্র তৈরি করে।
আবার সমুদ্রের উপরিভাগের যেখানে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয় সেই ঘাটতিও দূর করে তিমিদের মল-মূত্র। ফলে সমুদ্রের সার্বিক প্রাণ ও প্রকৃতির বাস্তু সংস্থানের ভারসাম্য রক্ষা করে তিমিরা। এজন্যই তিমিদেরকে সামুদ্রিক ‘ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার’ নামকরণ করেন গবেষক রোমান ও তার সহকর্মীরা। সূতরাং সমুদ্রে তিমির সংখ্যা কমে আসলে সমুদ্রের প্রাণ ও প্রকৃতির বাস্তুসংস্থানে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
অনেকে বলেন তিমিরা সমুদ্রের মাছ খেয়ে শেষ করে ফেলে। যে কারণে আমরা বেশি মাছ পাই না। কিন্তু বাস্তবতা হলো তিমিরা না থাকলে মাছেরাও বাঁচতে পারবে না। কারণ তিমিরা যদি সমুদ্রের গভীরে গিয়ে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে পুনরায় সমুদ্রের উপরিভাবে এসে মল-মূত্র ত্যাগ না করে তাহলে উপরিভাগের মাছেরা অপুষ্টিতে মরে যাবে।
তিমি মাছ ছাড়া অন্যান্য মাছেদের মল-মূত্রও সমুদ্রের প্রাণ ও প্রকৃতির বাস্তসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখছে। টারকুইজ কিলি মাছের মল অন্য মাছেদের বুড়িয়ে যাওয়ার গতি ধীর করে দেয়। এবং ইলগ্রাস নামের এক প্রজাতির সামুদ্রিক উদ্ভিদের বংশবিস্তারে সহায়তা করে। এছাড়া মাছেদের পায়খানা সমুদ্রের পানিতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমাতেও সহায়তা করে। ফসফরাস সমৃদ্ধ মাছেদের পেশাব কোরালজাতীয় উদ্ভিদদের বংশবিস্তারে সহায়তা করে।
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন তাহলে সমুদ্রের পানির কতটুকু এর প্রাণীদের মল-মূত্র? আসলে এর কোনো সঠিক হিসাব বের করা সম্ভব নয়। তবে তা খুবই নগন্য হওয়ারই কথা। কারণ পৃথিবীজুড়ে সমুদ্রের পানির পরিমাণ ১৩০ কোটি কিউবিক মাইল। যা এতটাই বিশাল যে, তিমিরা যদি প্রতিদিন হাজার হাজার গ্যালনও পেশাব করে তাতেও তা কয়েক ফোটারই সমতুল্য থেকে যাবে।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন