শুধু চলতি বছরেই নেপালকে ৮.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন, যা হিমালয়ান রাজ্যটিতে চীনের বড় আকারে প্রবেশের বার্তা বহন করছে। আর ভারতের সঙ্গে উন্মুক্ত সীমান্তের কারণে নেপালকে দক্ষিণ এশিয়ায় সম্ভাব্য প্রবেশ পথ হিসেবে দেখতে শুরু করে করেছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশটি।
নেপালি কর্মকর্তারা জানান, চীনা সহায়তার মধ্যে রয়েছে মঞ্জুরি, সুদ-মুক্ত ঋণ ও রেয়াতি ঋণ। নেপালের নিরাপত্তা ও সামরিক প্রকল্পগুলোতে বেইজিংয়ের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ সহায়তাও আসছে। অন্যদিকে, নেপালের উত্তর সীমান্ত এলাকায় তিব্বত স্বশাসিত অঞ্চলের সরকার প্রকল্পভিত্তিক সাহায্য দিচ্ছে।
নেপাল ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পর থেকেই দেশটিতে চীনের সাহায্যের পরিমাণ বেড়ে যায়। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত পাঁচ বছর ধরে কাঠমান্ডুর সবচেয়ে বড় বিদেশী সাহায্যদাতা হলো বেইজিং।
গত মার্চে নেপাল বিনিয়োগ সম্মেলনে ১৬টি চীনা প্রতিষ্ঠান নেপাল সরকারের সঙ্গে ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ সই করে। তাছাড়া চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন নেপালের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা নেপালে একটি হাসপাতাল ও কাঠমান্ডুতে মেট্রোপথ নির্মাণে বিনিয়োগ করার কথা জানায়। যা কোন একটি কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি।
কাঠমান্ডু ‘অঞ্চল ও সড়ক উদ্যোগ’ (বিআরআই) সংশ্লিষ্ট এমওইউ সই করার পর থেকে এই উদ্যোগের আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের জন্য নেপালকে চাপ দিয়ে আসছে চীন। এই এমওইউ’তে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয় বাণিজ্য কানেকটিভিটি ও আর্থিক একীভবনের উপর। এই উদ্যোগের আওতায় নেপাল তার জরুরি অবকাঠামো উন্নত করা ও আন্ত:সীমান্ত কানেকটিভিটি জোরদারের আশা করছে।
বিআরআই প্রকল্প নির্বাচনের জন্য নেপাল একটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি এ পর্যন্ত দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, দুটি আন্ত:সীমান্ত বিদ্যুৎ গ্রিড, একটি আন্ত:সীমান্ত রেলপথ এবং দুটি সড়ক প্রকল্প চিহ্নিত করেছে। এসব প্রকল্পে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে।
নেপালের পর্যটন খাত থেকে সুফল আদায়ে আগ্রহী চীনের বেসরকারি খাত। পর্যটকদের প্রথম গন্তব্য কাঠমান্ডুর কেন্দ্রস্থল থামেল-এ ইতোমধ্যে চায়না টাউন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা নেপালের মাঠ পর্যায়ে চীনের বিজরিত হওয়ার একটি স্বাক্ষী।
কাঠমান্ডুর অনেকে মনে করেন নেপালকে ঘিরে চীনা উদ্যোগুলোর প্রভাব হবে দ্বিমুখি: এতে ভারতের ওপর নেপালের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমবে, আবার ভারতের সঙ্গে নেপালের উন্মুক্ত সীমান্ত থাকায় ভারতের বাজারে আরো বড় আকারে প্রবেশ করতে পারবে চীন।
তিন বছর আগেই নেপালের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক সাহায্যদাতা হিসেবে ভারতের আসনটি চীন দখল করে নেয়। আর, ২০০৬ সাল থেকে নয়া দিল্লির চেয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে কাঠমান্ডুর বাণিজ্য ১৭ গুণ বেশি গতিতে বেড়ে চলেছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন সম্প্রতি নেপালের সবচেয়ে বড় দুই কমিউনিস্ট পার্টিকে এক করার পেছনে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে, চীনের স্বার্থের প্রতি সহানুভুতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে শক্তিশালী করতে বেইজিংয়ের আগ্রহের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে।
সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (সিএসএএস)’র পরিচালক নিশাচল নাথ পান্ডে বলেন, ‘দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর খ্যাতি রয়েছে। তাই আমাদের মতো সমাজ যেখানে ধীর গতির কাজের জন্য জনগণ সরকারের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেছে সেখানে চীনা কোম্পানি ও বিনিয়োগের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই জনগণের সমর্থন পাওয়া যাবে।’
তবে, চীনের বিনিয়োগ সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত বলে কেউ কেউ মনে করেন। তারা এ জন্য আফ্রিকা ও শ্রীলংকার প্রতি তাকানোর কথা বলেন। চীনের কাছ থেকে ব্যাপক সহায়তা নিয়ে দেশটি যেন ঋণের ফাঁদে না পড়ে সে ব্যাপারে তারা সতর্ক করেন।
নেপালে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ ভারতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। নেপালের কর্মকর্তারা হিন্দুস্তান টাইমসকে জানান যে নয়া দিল্লি নেপাল সরকার ও ব্যবাসায়ী সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে চীন বা অন্য কোন দেশ থেকে বিনিয়োগ নিয়ে নেপাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করলে তা থেকে ভারত বিদ্যুৎ কিনবে না।
অবশ্য ভারত ও নেপালের মধ্যে বাণিজ্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে অনেকে স্বস্তি অনুভব করেন। ২০১৬-১৭ সালে দু’দেশের মধ্যে ৬.৩৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। এর মধ্যে ভারত ৫.৯৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য নেপালে রফতানি করে।
নেপালের ঘটনাবলীর ওপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখেন এমন একজনা ভারতের সাবেক কূটনীতিক লোক রাজ বরাল বলেন, ‘নেপালে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’
বড়াল উল্লেখ করেন যে চীন যেমন ভারতে বিনিয়োগ করছে, তেমনি বহু ভারতীয় প্রতিষ্ঠান চীনেও বিনিয়োগ করছে। তাই নেপাল তার সমৃদ্ধির জন্য যেকোন দেশ থেকে বিনিয়োগ নিক না কেন তাতে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন