আর্থিক খাত অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল খাত। অথচ এ খাত সবচেয়ে অরক্ষিত। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার মডেল স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। প্রশাসনের সর্বস্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। অবাধে কালো টাকার সঞ্চালন ও পুঁজিপাচার হচ্ছে। দেশ ক্রমেই নৈতিকতাহীন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঝুঁকছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে, বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন অর্থনীতির চেয়ে অনৈতিকতা নিয়ে আরও বেশি আলোচনার সময় এসেছে। কীভাবে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনা যায় সে উদ্যোগ দরকার।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এবং সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনাসভায় এসব মন্তব্য করেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। ‘অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন নোয়াবের সভাপতি এ. কে. আজাদ এমপি। সমাপনী বক্তব্য দেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম।
সভায় বক্তব্য দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক অর্থসচিব ও সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সামগ্রিক অর্থনীতিতে টানাপোড়েন বা ভঙ্গুরতা চলছে। অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি, রাজস্ব সংগ্রহে স্বল্পতা, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা, পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা, সর্বব্যাপী দুর্নীতি, সরকারি ব্যয়ে অনিয়ম, অপচয় ও জবাবদিহিহীন বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের চাপের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বাজেটকে বলা যায়, যূপকাষ্ঠে বাঁধা বলির পশুর মতো বা ‘স্যাক্রিফিশিয়াল ল্যাম্ব’, যার হাত-পা বাঁধা, নড়াচড়া করার খুব সুযোগ নেই।
ব্যাংক খাত নিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাংক খাত চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। বিভিন্ন অনুগত স্বার্থগোষ্ঠীকে ব্যাংক থেকে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতি সম্পৃক্ত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে, বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সৎ উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হন। সুতরাং পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে আর্থিক খাতসহ কিছু সংবেদনশীল খাতকে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে যাতে অবৈধ অর্থ তৈরি না হয় সেজন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তৈরি করা হয়। কিন্তু সেটিও ঠিকমতো কাজ করছে না। এতে অবাধে কালোটাকার সঞ্চরণ হচ্ছে। পুঁজিপাচার হচ্ছে। দেশ ক্রমেই নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঝুঁকছে। এখন অর্থনীতির চেয়ে অনৈতিকতা নিয়ে আরও বেশি আলোচনার সময় এসেছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বলা হচ্ছে সংকোচনমূলক বাজেট, অথচ বাজেটের ঘাটতি সংকোচনমূলক মনে হয় না। ঘাটতি মেটাতে সরকার যদি বেশি ব্যাংক ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত কীভাবে ঋণ পাবে? আর ব্যক্তিগত খাত ঋণ না পেলে কর্মসংস্থান হবে কীভাবে? তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে বাজারে তদারকি এবং পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। তা না করে কেবল বাজেট সংকোচন করে কাজ হবে না। খেলাপি ঋণ মডেলই এখন দেশের জন্য একটা বিজনেস মডেল হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আপনি ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন, আর ফেরত দেবেন না। এখন এই মডেল চলছে।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এবারের বাজেট প্রণয়নে অলিগার্ক বা লুটেরা গোষ্ঠীর কথা শুনেছেন অর্থমন্ত্রী, যারা ক্ষমতার প্রশ্রয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এই শ্রেণিগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার এই বিশেষ শ্রেণির কথা চিন্তা করে অর্থনীতিতে সংস্কার ও ব্যাংক খাত নিয়ে তেমন আলোচনা করা হয়নি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথাও শুনেছেন অর্থমন্ত্রী। আইএমএফ বলেছে, এবার বেশি উচ্চাকাক্সক্ষী বাজেট করা যাবে না। কারণ, সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে কার কথা শোনেননি অর্থমন্ত্রী-এমন ব্যাখ্যাও দিয়েছেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তার মতে, এই দুই শ্রেণি হলো-পরিশ্রমী উদ্যোক্তা এবং পরিশ্রমী কর্মী।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করেছি। সমস্যা একদিনে তৈরি হয়নি, তাই সমাধানও একদিনে হবে না। ব্যাংক খাত নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক খাত থেকে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার টাকা পাচ্ছে না, ব্যবসায়ীরাও পাচ্ছেন না। কেন পাচ্ছে না? এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? তিনি বলেন, বলা হচ্ছে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। ব্যাংক খাত এত দুর্বল যে আমানতের প্রবৃদ্ধি ভালো নয়। আমানতের প্রবৃদ্ধির মোট পরিমাণ ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না। সেখান থেকে সরকারই যদি ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়, তাহলে আর কী থাকবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন