গ্রামগঞ্জে এমনও মা আছেন, যার সন্তান মারা গেছে সেই কবে। তবু পথেঘাটে খুঁজে ফেরেন সন্তানকে। নিজের সন্তানের মতো কাউকে দেখতে পেলে তার চোখেমুখে হাত বুলিয়ে হু-হু করে কেঁদে ওঠেন। যার হারিয়েছে, সে বোঝে হারানোর কী যাতনা।
পরিবারের শক্ত বাঁধন খসে গেলে জীবন আর চলতে চায় না। সড়ক না রণক্ষেত্র, না দাঙ্গা-ফ্যাসাদের মাঠ। অথচ এখন সড়ক মানে দুর্ঘটনা; সড়ক এখন মৃত্যুর প্রতিশব্দ। সড়কে প্রতিদিন ঝরে যাচ্ছে কত প্রাণ!
এখনো, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, মানুষের কাছে পরিবার সবকিছু। সবার আগে বিবেচ্য পরিবার। ফুরসত হলেই নিজস্ব বা ভাড়া গাড়িতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন অনেকে। এ আনন্দ অফুরন্ত। কিন্তু সড়কে নেমে বাড়িতে ফিরছে লাশ হয়ে। প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনায় নিশ্চিহ্ন হচ্ছে গোটা পরিবার। যদিওবা কেউ বেঁচে থাকে, তার বা তাদের আহাজারি সওয়ার মতো নয়।
‘২২ বছর আগে স্বামীকে হারায়ে অনেক কষ্টে পোলাগো মানুষ করছি। এত কষ্টের পর শুধু সুখের মুখ দেহা ধরছিলাম। সুখ আর আমার কপালে সহ্য হইল না। আল্লায় এইডা কী করল? আমারে নিল না ক্যান? আমি এ জীবন কেমনে কাডামু!’
এ আহাজারি হালিমা বেগমের। হবিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ছেলে, নাতি ও পুত্রবধূকে একসঙ্গে হারিয়েছেন তিনি। গত ১ মে ঢাকান্ডসিলেট মহাসড়কের হরিতলায় ট্রাক-প্রাইভেট কার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। হালিমা বেগমের ছেলেরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি প্রাইভেট কারে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের কাছে ফিরেছে লাশ হয়ে।
ওই ঘটনায় একেবারে ভেঙে পড়েছেন পরিবারের বেঁচে থাকা সদস্যরা। শুধু হবিগঞ্জেই যে এমন ঘটনা ঘটেছে তা নয়, সাম্প্রতিককালে সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক সদস্যের মৃত্যুর ঘটনা স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। এমন মৃত্যুর সংবাদে শোকে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে পুরো এলাকা। একসঙ্গে এত মৃত্যুর শোক সইতে অক্ষম নিহতদের স্বজন ও প্রতিবেশীরা। এমন ঘটনায় পুরো পরিবার পড়ে যায় খাদের কিনারায়। যেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব।
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটু স্বস্তির ভ্রমণের জন্য প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় বেড়াতে যান অনেকেই। আর তাতেই শোকগাথা তৈরি হচ্ছে পরিবারগুলোর।
সড়কে দিন দিন মৃত্যুর সারি দীর্ঘতর হচ্ছে। গত মার্চ মাসে ৫৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১ হাজার ২২৮ জন। সাম্প্রতিককালে পারিবারিকভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এক মাসের ব্যবধানে ফরিদপুর সদরে যাত্রীবাহী বাস ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
গত ৩ মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় প্রাইভেট কার খাদে পড়ে একই পরিবারের তিনজন নিহত হয়। ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় আত্মীয়ের জানাজা শেষে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মা-ছেলের মৃত্যু হয়েছে। গত ৯ এপ্রিল ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ল্যাংড়াবাজার এলাকায় টাঙ্গাইলগামী একটি যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় মাহেন্দ্র অটোরিকশায় থাকা একই পরিবারের তিনজন নিহত হয়। গত ১৮ মার্চ সিলেটের জৈন্তাপুরে পিকআপ ও লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়। গত ২০ মার্চ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত পাঁচজনের মধ্যে এক পরিবারের চারজন রয়েছে। এর আগে লক্ষ্মীপুরে একই পরিবারের ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
হবিগঞ্জে নিহত জামাল হোসাইন ঢাকার সাভারে পাইওনিয়ার গ্রুপের মেক্স কম ইন্টারন্যাশনাল বিডি লিমিটেডের ইলেকট্রিশিয়ান ইনচার্জ ছিলেন। তার ছোট ভাই এনামুল হক খোকন একই এলাকার বেবিলন গ্রুপের অবনী ফ্যাশনের সিনিয়র সুইং অপারেটর ছিলেন। নিহত দুই ভাইয়ের মামা মো. সোনা মিয়া বলেন, ‘আমার ভাগ্নেরা সাভারে চাকরি করত। খুবই ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের ছিল। ওদের মৃত্যু আমার বোন মানতে পারছে না। ওই পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকায় তারা অসহায় হয়ে পড়েছে।’
বরগুনার আমতলী উপজেলার পশ্চিম চুনাখালীর আবুল কালাম সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও ছেলেকে হারান। পরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনিও মারা যান। এমন মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নামে। পরিবারের বেঁচে থাকা একমাত্র মেয়ে পারভিন আক্তারের কান্না থামছেই না।
মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাগুলোর কারণ জানার চেষ্টা করেছে দেশ রূপান্তর। প্রাইভেট কার কিংবা মাইক্রোবাস ভাড়া করে অথবা নিজস্ব গাড়ি করে দলবদ্ধভাবে ঘুরতে যাওয়া একটা কারণ বটে। আর বড় কারণ হচ্ছে সড়কে গাড়িগুলোর বেপরোয়া গতি, নিয়ম লঙ্ঘন করার প্রবণতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ায় পরিবারের সবার একসঙ্গে যাতায়াতের প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে মর্মান্তিক এসব ঘটনা ঘটছে, যার দায় কোনোমতেই এড়াতে পারে না সড়ক বিভাগ ও ট্রাফিক বিভাগ।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলবদ্ধ যাত্রায় দুর্ঘটনায় ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন অনেকটাই দায়ী। মূলত দুই কারণে একই পরিবারের সদস্যরা দুর্ঘটনায় পড়ে বেশি। সাধারণত চালক টানা ট্রিপ দেওয়ায় সজাগ থেকে গাড়ি চালাতে পারেন না। আবার অনেক পরিবারের সাধ আছে কিন্তু সামর্থ্য নেই। সদস্যরা খরচ বাঁচাতে বাসে না গিয়ে ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে চলাচল করে। ফলে সবচেয়ে বেশি নিহত হয় এমন পরিবারের সদস্যরাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আইনুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আর্থিক সক্ষমতা বাড়ায় মানুষের মুভিলিটি বেড়েছে। পারিবারিক বন্ধন, আর্থিক সচ্ছলতা সব মিলিয়ে একসঙ্গে ঘোরার হার বেড়েছে। গত ২০ বছরে মানুষের সচ্ছলতা বেড়েছে। টাকান্ডপয়সা থাকায় তারা গাড়ি ভাড়া করে কিংবা নিজস্ব গাড়িতে একসঙ্গে বেড়াতে যায়। এর ফলে একই পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই মর্মান্তিক ঘটনায় পড়েন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম আমানউল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে পরিবারের একাধিক সদস্য মারা যাচ্ছে সে অসহায় হয়ে পড়ছে। তাদের আয় রোজগার সবই শেষ। তারা রাষ্ট্রের সহযোগিতা পাচ্ছে না, সমাজেরও পাচ্ছে না। কেউ কেউ এককালীন কিছু আর্থিক সুবিধা পেলেও সেটা দিয়ে চলে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে পরিবার আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। দুর্ঘটনার সঠিক বিচারও নেই। ট্রান্সপোর্ট সেক্টর মাফিয়াদের দখলে। হাইওয়েগুলোতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দিন দিন হবসিয়ান স্টেটে অর্থাৎ স্বার্থপরের রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হচ্ছে এ দেশ। কেউ নিয়মকানুন মানে না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন