টাকার অবমূল্যায়ন ও সিন্ডিকেটের কারসাজিতে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো গেলে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতো। কিন্তু সেভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম এসব কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন -দেলোয়ার হুসেন
যুগান্তর : বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব ও দেশীয় সংকটের ক্ষত মোকাবিলায় আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
ড. মইনুল ইসলাম : করোনার সময় অর্থনীতিতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশীয় সংকট। কারণ, দেশের অর্থনীতি আগে থেকেই নানা সংকটে আক্রান্ত ছিল। এ ত্রিমুখী সংকটে পড়ে দেশের অর্থনীতি আরও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এ সংকট থেকে মানুষকে উপশম দিতে সরকারের জনবান্ধব বাজেট করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে সরকার বাজেটে করের বোঝা চাপিয়েছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সরকার ব্যয় বাড়িয়েছে। এর মধ্যে জনকল্যাণে যতটুকু ব্যয় হয়েছে, এর চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে বিলাসবহুল প্রকল্পে। যেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো না করে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বাজেটে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। উৎপাদনমুখী খাতে টাকার প্রবাহ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মানুষের কল্যাণে ব্যয় বাড়াতে হবে।
যুগান্তর : আইএমএফ আগামী বাজেট ছোট করতে বলেছে। আপনি কী মনে করেন?
ড. মইনুল ইসলাম : শতভাগ সত্য ও যৌক্তিক কথা বলেছে আইএমএফ। কারণ, বাজেট ছোট করা ছাড়া উপায় নেই। বাজেট বড় করলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ফলে সরকারকে ব্যয় করতে ঋণ নিতে হচ্ছে। ঋণ নিয়ে সরকার অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ করছে। এতে ঋণের বোঝা বাড়ছে। বাজেটের এ ঋণ জনগণের করের টাকায় সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে। বাজেট ছোট করলে একদিকে ঋণের বোঝা কমবে, অন্যদিকে সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় রোধ হবে। এতে অর্থনৈতিক মন্দায় সরকারের নেওয়া কৃচ্ছ সাধন নীতি আরও কার্যকর হবে।
যুগান্তর : সরকার বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি জোর দিয়েছে, এতে ঋণের বোঝা বাড়ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. মইনুল ইসলাম : আমাদের এখানে বেশির ভাগই আগাম সমীক্ষা ছাড়াই উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়। ফলে প্রকল্পের ভালো-মন্দ বোঝা যায় না। অর্ধেক বা পুরো কাজের পর দেখা যায়, প্রকল্পটি জনকল্যাণে তেমন কাজে আসছে না। এগুলো বন্ধ করতে হবে। প্রকল্প নেওয়ার আগে জনগণের কতটুকু কাজে আসবে, তা সমীক্ষা করে দেখা উচিত।
যুগান্তর : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এরপরও এর ঊর্ধ্বগতি কমছে না কেন?
ড. মইনুল ইসলাম : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ । ভারতে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শ্রীলংকায় নেমে এসেছে ৪ শতাংশে। যেসব দেশে মূল্য¯ফীতি বেড়েছিল, তারা একে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে বিশেষ করে দরিদ্র, স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেশি আয়ের মানুষ মূল্যস্ফীতির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। সরকারের নীতি প্রণয়নের সঙ্গে এখন যারা জড়িত, তারা সবাই উচ্চ আয়ের মানুষ। যে কারণে তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
যুগান্তর : মূল্যস্ফীতি কমাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
ড. মইনুল ইসলাম : শুধু সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। এর জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। ডলারের দাম বাড়িয়ে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে হবে। টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে ডলারের দাম বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে। তখন ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে অত্যন্ত মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাবে। এছাড়া সিন্ডিকেটের কারসাজির মাধ্যমে যারা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে পণ্যের দামে স্থিতিশীলতা আসবে। তখন এমনিতেই মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।
যুগান্তর : দীর্ঘদিন দেশে ডলার সংকট চলছে। এ সংকট সমাধানে করণীয় কী হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ড. মইনুল ইসলাম : ডলার সংকট নিরসন করতে হলে সবার আগে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে হুন্ডির কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে। এ তিনটি পদক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বাস্তবায়ন করলে ডলার সংকট কেটে যাবে। এখন রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স বা বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে যেসব ডলার দেশে আসছে, সেগুলোর একটি অংশ আমদানি বা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। হুন্ডি বন্ধ হলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় যেমন বাড়বে, তেমনই দেশ থেকে টাকা পাচার কমবে। আমদানি-রপ্তানির নামে যেসব টাকা পাচার করা হয়, সেগুলো বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে।
যুগান্তর : ব্যাংক খাত, খেলাপি ঋণ-এগুলোকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. মইনুল ইসলাম : ব্যাংক খাতের অবস্থা খুবই খারাপ। দীর্ঘ সময় ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব, ঋণখেলাপিদের তোষণ, রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া, জালজালিয়াতি, টাকা পাচারের কারণে ব্যাংকগুলো এখন বিপর্যস্ত। খাতটি অর্থনীতিতে টাকার জোগান দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেয়ে এখন নিজেদের বাঁচাতেই ব্যস্ত। কারণ, অনেক ব্যাংকে এখন চাহিদা অনুযায়ী মূলধন নেই। আমানতের প্রবাহ কম। যে কারণে ব্যাংকগুলো এখন ভুগছে। এটি হতো না, যদি ব্যাংক থেকে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া না হতো, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতো, খেলাপিদের নতুন ঋণ দেওয়া না হতো, জালজালিয়াতি বন্ধ করা হতো, সুশাসনের প্রয়োগ হতো-তাহলে ঋণ বা খেলাপির নামে টাকা পাচারও কম হতো।
যুগান্তর : বৈশ্বিক ব্যবস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশেও সুদের হার বাড়ছে। এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ড. মইনুল ইসলাম : করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে অর্থনীতি অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছিল। এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। যে কারণে সুদহারও বাড়ছে। সুদ বেশি বেড়ে গেলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এতে বাড়বে পণ্যের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতিতে আবার বাড়তি চাপ পড়বে। কর্মসংস্থানের হার কমে যাবে।
যুগান্তর : বৈদেশিক ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনার মতামত কী?
ড. মইনুল ইসলাম : বৈদেশিক ঋণ ও এর ব্যবহার অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। এ ঋণ নিতে হয় উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী খাতে। তাহলে রপ্তানি আয় দিয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সহজ হবে। কিন্তু দেশে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে যত্রতত্র। ব্যবহারও হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। ঋণের কিছু অর্থ আবার পাচারও হয়েছে। দুই বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। ঋণের সুদ বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। যে কারণে এখন ঋণ শোধ করতে একদিকে বেশি অর্থ লাগছে, ডলার সংকটের কারণে পর্যাপ্ত ডলারও নেই-সব মিলে বৈদেশিক ঋণ এখন অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন